কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাত চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অস্থিরতা এখন গভীর হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে দেশের ব্যাংক খাত। মূলধনের অপর্যাপ্ততা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ, গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে আর্থিক খাত। আমি প্রথমে বলব ব্যাংক খাতকে গভীর সংকটে ফেলার জন্য দায়ী হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা মেনে চলত ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক—বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদ্যমান ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যেকোনো নির্দেশনা দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ।
দুঃখজনক যে বিগত ১৫ বছরে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ইউনিট অফিস হিসেবে কাজ করেছে। পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে কাজ করতে ব্যর্থ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা হলো অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। ব্যাংক ব্যবস্থা সচল না থাকলে পুরো অর্থনীতির চাকা মুহূর্তের মধ্যে থেমে যাবে। এখন অর্থনীতির চাকা খুবই ধীরে ধীরে ঘুরছে। তার কারণ হলো ব্যাংক খাতের অস্থিরতা ও স্থবিরতা। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় বড় ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের সমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কেটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
তবে এখন পুনঃতফসিল করা ঋণ, আদালতের আদেশে স্থগিত করা ঋণ মিলিয়ে খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ শতাংশ খেলপি। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের খেলাপি ৮ শতাংশ। বর্তমানে ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রভিশনিং ঘাটতি রয়েছে ১৫টির বেশি ব্যাংকে। ব্যাসেল নীতি-৩ অনুযায়ী, মূলধন পর্যাপ্ততার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ২০২৩-এর গবেষণা রিপোর্টে বাংলাদেশকে দুর্বলতম ব্যাংকিং ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় খেলাপি ঋণের হার বেশি (১৫ শতাংশ)। বিশ্বব্যাংক আরো বলেছে যে বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো বিগত সরকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালীদের একের পর এক ছাড় দেয়া হয়। আইন শিথিল করে কিছু বিশেষ ব্যক্তি ও শিল্প গোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ এখন আকাশচুম্বী। মূলধন ঘাটটিতে পড়ে গেছে প্রায় ১৫টি ব্যাংক।
বর্তমানে ৯টি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগদানের পর থেকে ঋণখেলাপিদের স্বার্থে নতুন নতুন নীতি প্রণয়ন করা শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গণমাধ্যম স্বাধীনতা (প্রেস ফ্রিডম) খর্ব করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ফলে ব্যাংক খাতে বাড়তে থাকে সীমাহীন দুর্নীতি। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে বকেয়া কিস্তি ও বিনিয়োগের স্থিতির ওপর জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। পরে আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ করে দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
এছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুবিধা প্রদান এবং পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্লেখ্য, আগে পুনঃতফসিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। আরো বলা দরকার যে গভর্নর রউফ তালুকদারের সময় খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। একসময় খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে দুই বছর সময় দেয়া হতো। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দিনের পর দিন টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিলের মাধ্যমে ডলার ধার দিয়েছে প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীকে। ডলারে ঋণও খেলাপি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে প্রায় সাত কোটি ডলার। দুঃখজনক যে ব্যাংক খাত থেকে লুণ্ঠিত অর্থ পাচার হয়ে গেছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৮৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আমি মনে করি যে আওয়ামী লীগ সরকারের বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৫টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া। ব্যাংক খাতের দুরবস্থার জন্য দায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগটি বন্ধ করে দেয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করছি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একসময় নাম ছিল ‘ব্যাংকিং বিভাগ’।
২০১০ সালে নতুন নামকরণ করা হয় ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ নামে। ২০১৭ সালে নাম দেয়া হয় ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’। বলা প্রয়োজন যে ২০১০ সালে ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ প্রবর্তন করা হলে এক মাস পরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধি দল বলেছিল যে বিভাগটি গঠিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কল্লন সঠিক হয়। সত্যি সত্যি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ থেকে লাগাম টেনে ধরা হয়। এ বিভাগ থেকে তদবির বাণিজ্য হয়। ব্যাংক খাতের অনিয়ম এখান থেকে পরিচালিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে এ বিভাগ।
বিগত দেড় দশকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমে কথা বলার সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়ে সমালোচনা করতেন। ব্যাংক খাতে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণী তৈরি হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে। ‘অলিগার্ক’ শ্রেণী পুঁজি লুণ্ঠন করেছে, পুঁজি পাচার করেছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের ধারণা এসেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে। বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে। ব্যাংক কোম্পানি সংশোধনী আইন ২০১৮-এ একজন পরিচালকের মেয়াদ একাধারে ৬ বছর থেকে ৯ বছরে উন্নীত করা হয়। ২০১৮ সালে সংশোধনী আইনে আরো বলা হয় যে এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক থাকতে পারবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০২৩ সালে আবার সংশোধন করা হয়। এ সংশোধনীতে পরিচালকের মেয়াদ ৯ বছর থেকে ১২ বছরে উন্নীত করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংক খাত পরিবারতন্ত্রে রূপ নেয়। ব্যাংক খাত পড়ে যায় গভীর সংকটে। একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংকগুলো মুক্ত করার জন্য পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি জানত না লুটপাট ও টাকা পাচারের তথ্য?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক খাতের দুর্নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য ব্যাংকিং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স মূলত তিনটি কাজ প্রথমে করবে—১. ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ নির্ণয় করবে, ২. ব্যাংকগুলোর সম্পদ চিহ্নিত করবে, ৩. ব্যাংকগুলোর সম্পদ পুনরুদ্ধার করবে। আমি মনে করি টাস্কফোর্সের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করে অতি দ্রুত জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
সেই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অবলুপ্ত করার সুপারিশ করা যেতে পারে। অতিদ্রুত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকগুলোকে পরিবারতন্ত্র থেকে রেহাই দিতে হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুনাম অর্জন এবং দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর জন্য এ মুহূর্তে ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই।
মো. মাজেদুল হক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সদস্য