অভিমত

সমুদ্রবন্দরের সংখ্যা বাড়লেও দক্ষতা বাড়ছে কি?

ঔপনিবেশিক আমলে এ উপমহাদেশ থেকে ইউরোপীয় বিশেষত ইংরেজ বণিকদের নিয়ে যাওয়া কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ যে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবকে ব্যাপকভাবে সহায়তা ও ত্বরান্বিত করেছিল, সেটি আজ সর্বজনীন ইতিহাসের স্বীকৃত তথ্য। তো, সে তথ্য সামনে আসার সুবাদে একই সঙ্গে অন্য যে ঘটনাটি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে উল্লিখিত কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ এ দেশ থেকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার জন্য

ঔপনিবেশিক আমলে এ উপমহাদেশ থেকে ইউরোপীয় বিশেষত ইংরেজ বণিকদের নিয়ে যাওয়া কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ যে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবকে ব্যাপকভাবে সহায়তা ও ত্বরান্বিত করেছিল, সেটি আজ সর্বজনীন ইতিহাসের স্বীকৃত তথ্য। তো, সে তথ্য সামনে আসার সুবাদে একই সঙ্গে অন্য যে ঘটনাটি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে উল্লিখিত কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ এ দেশ থেকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার জন্য অতিসীমিত পর্যায়ের সামুদ্রিক নৌযান ব্যতীত অন্য তেমন কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা তখন ছিল না বললেই চলে। আর সে সীমিত নৌ চলাচলের জন্যও বন্দর বা এ জাতীয় উপযুক্ত কোনো অবকাঠামো তখন একেবারেই ছিল না। এমনি পরিস্থিতিতে ইংরেজরা তাদের নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই ১৮৮৭ সালে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে তোলে, ২০৩৭ সালে যার ১৫০ বছর পূর্ণ হবে। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ববর্তী ১৩৬ বছর ধরে এ চট্টগ্রাম বন্দরই ছিল বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্রবন্দর।

পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে খুলনার চালনায় (পরে মোংলা) এবং ২০১৬ সালে পটুয়াখালীর পায়রায় যথাক্রমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমুদ্রবন্দর গড়ে ওঠে। চতুর্থটি গড়ে ওঠার অপেক্ষায় আছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে, যা ২০২৬ সাল নাগাদ চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ, বন্দরগুলোর ভৌতক্ষমতা (জেটি সংখ্যা ও অন্যান্য) এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিলে এ দেশে চারটি সমুদ্রবন্দর থাকা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাত মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে বন্দরগুলোর মান ও দক্ষতা এতটাই নিম্নবর্তী যে এতসংখ্যক বন্দর থাকা সত্ত্বেও পণ্য জাহাজীকরণ ও খালাসের জন্য সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের এখনো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়, যার সঙ্গে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করার ধরনের যথেষ্ট মিল রয়েছে। আর হয়রানি ও উপরি পরিশোধের ক্ষেত্রে এর তুলনা মেলাই ভার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন দিন দিনই বড় হচ্ছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় বাড়ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণও, যার জন্য প্রতিনিয়তই রয়েছে বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা। বন্দর ব্যবস্থাপনা দক্ষ, হয়রানিমুক্ত ও গতিশীল হলে আমদানি-রফতানির পরিমাণই শুধু বাড়ে না, পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বহুলাংশে কমে আসে। বাড়ে মুনাফার পরিমাণও। আর তা না হলে এর বিপরীতটি ঘটাই স্বাভাবিক এবং ঘটছেও তাই এবং এর ফলে অর্থাৎ শুধু বন্দরের অদক্ষতার কারণে বহুক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানির পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত পরিসরে বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না কিংবা বহুক্ষেত্রে তা কমেও যাচ্ছে। এ রকম উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে যে শুধু বন্দরের অনিশ্চয়তার কারণে বহু বিদেশী ক্রেতা বাংলাদেশে যে মানে ও মূল্যে একটি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে নিম্নমানের পণ্য এরচেয়ে অধিক দাম দিয়ে অন্য দেশ থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। 

বন্দরের অকর্মণ্যতা ও জটিলতায় সৃষ্ট বিলম্বের কারণে বিদেশী ক্রেতার সঙ্গে বাংলাদেশী রফতানিকারকের বিবাদ ও মনকষাকষি হয়নি—এ ধরনের উদাহরণ এক-দুটিও আছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। আর এ ধরনের বিলম্বের কারণে সময়মতো বিল না পাওয়া, কার্যাদেশের আওতায় অবশিষ্ট পণ্য নিতে না চাওয়া বা গড়িমসি করা, ভুক্তভোগী ক্রেতার কাছ থেকে আর নতুন কার্যাদেশ না পাওয়া ইত্যাদি তো প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু ঘটনা যে বাংলাদেশের বন্দরগুলোর অদক্ষতা, অবহেলা ও গড়িমসির কারণেই ঘটছে সেটি ভেবে বন্দরের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কখনো অনুতপ্ত হয়েছেন বলে জানা নেই। এমনকি এমনটা যে ঘটছে সেটি তাদের কেউ কেউ জানলেও সবার চিন্তা ও ধারণায় আছে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ভারতের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ও নেপালের সঙ্গে আংশিক ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর সম্ভাবনা এখন বহুলাংশে বেড়ে গেছে। কিন্তু উল্লিখিত চুক্তিগুলোর কিছু দুর্বলতার কারণে এবং তার চেয়েও বড় কথা, বন্দরগুলোর দক্ষতায় ব্যাপক ঘাটতি থাকায় সে সম্ভাবনার একটি বড় অংশই কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ এ বন্দরের মাধ্যমে আহরিত রাজস্বই এখন বিশ্বের বহু দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ও চালিকাশক্তি, যেমন সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের মোট রাজস্ব আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই আসে বন্দর পরিচালনার আয় থেকে। অনুরূপ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষেও তার বন্দরগুলোর দক্ষতা ও সেবার পরিধি বাড়িয়ে এ সূত্রের রাজস্ব আহরণের পরিমাণকে বহুলাংশে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব।

এক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশের বন্দরগুলোর একটি বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তা হচ্ছে, এর কোনোটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। বিরাট বিরাট মাদার ভেসেল এসে যেভাবে সিঙ্গাপুর বন্দরে অবলীলায় ভিড়ে যেতে পারে, নাব্যতা ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের বন্দরগুলোয় তা সম্ভব নয়। তবে ২০২৬ সাল নাগাদ মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলে সে সমস্যা বা সীমাবদ্ধতাও বহুলাংশে কেটে যাবে। অবশ্য মাতারবাড়ী হয়তো কখনই সাংহাই, লস অ্যাঞ্জেলেস বা সিঙ্গাপুরের মতো অতবড় বন্দর হয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু যে বড় বড় মাদার ভেসেল বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না বলে সিঙ্গাপুর বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করতে হয়, মাতারবাড়ীর মাধ্যমে তার একটি স্থায়ী সমাধান হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু গভীর সমুদ্রবন্দরের সমস্যা মিটলেও বন্দরগুলোর অদক্ষতা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির সমস্যা মিটবে কেমন করে? এগুলোর অপনোদন ঘটাতে না পারলে শুধু বন্দরের সংখ্যা বাড়িয়ে কতটুকুইবা লাভবান হওয়া যাবে?

মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হতে আর মাত্র বছর দুয়েক বাকি। কিন্তু সে বন্দরকে দক্ষতার সঙ্গে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমাত্রিক পরিকল্পনা কি এরই মধ্যে প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে? মোটেও না। এটি এভাবে বলার কারণ হচ্ছে, এরই মধ্যে এটি জানা তথ্য যে মাতারবাড়ী বন্দর চালু হওয়ার পর এর পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে কোনো বিদেশী কোম্পানি। কিন্তু এ ধরনের বন্দর পরিচালনার দক্ষতা বাংলাদেশ নিজেরা কেন গড়ে তুলছে না? কেন আমরা ভাবছি যে এ কাজ আমরা কখনই করতে পারব না বা অনির্দিষ্ট কাল ধরে তা বিদেশীদের দিয়েই করাতে হবে? বন্দর যদি গড়ে তোলা যায়, তাহলে তা পরিচালনার সামর্থ্যও গড়ে তোলা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু বিষয়টি নিয়ে ভাবা। আর এ দক্ষতা বৃদ্ধি বলতে আমরা যেন শুধু মাতারবাড়ী বন্দরের দক্ষতাকেই না বুঝি। দক্ষতা যদি বাড়াতেই হয় তাহলে চারটি বন্দরের সবক’টির দক্ষতাই বাড়াতে হবে, অর্থাৎ তাদের সবাইকে সমদক্ষতাসম্পন্ন করে তুলতে হবে। 

এটি এখন বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক আলোচনা যে আগামী পৃথিবীর যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার মূল জায়গাটিই দখল করবে নৌপথ, নদী বা সমুদ্র যা-ই হোক না কেন। সেক্ষেত্রে সমুদ্র উপকূলীয় নিম্নভূমির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে সুবিধার এ ধারণাগত দিকটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে দক্ষতার কার্যকর উন্নয়ন, যার মধ্যে সমুদ্রবন্দরের দক্ষতা অন্যতম। আর সমুদ্রবন্দরের দক্ষতা বলতে আমরা যা বুঝতে চাই তার সরল অনুবাদ হচ্ছে—এক. কোনো একটি পণ্য বিদেশে রফতানির উদ্দেশ্যে কিংবা বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য বন্দরে এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তা জাহাজে উঠবে কিংবা জাহাজ থেকে খালাস হবে। আর এজন্য সংশ্লিষ্ট রফতানিকারক বা আমদানিকারককে কোনোরূপ হয়রানির মুখে পড়তে হবে না এবং এজন্য তাকে কোনো বাড়তি ব্যয়ও বহন করতে হবে না। অন্যদিকে এরূপ দক্ষতাপূর্ণ সেবা নিশ্চিত জন্য বন্দরে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তারা হবেন সেবাগ্রহীতাদের প্রতি আন্তরিক, সহায়তাপরায়ণ ও কর্মদক্ষ।

সব মিলিয়ে প্রত্যাশা এই যে দেশে বন্দরের সংখ্যা যেমনি বেড়েছে, তেমনি বাড়বে বন্দরের দক্ষতাও। আর তার সঙ্গে সংগতি রেখে এর সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতাই শুধু নিশ্চিত হবে না, একই সঙ্গে এর সেবাদান কার্যক্রমের সব স্তরে প্রতিষ্ঠিত হবে জবাবদিহিতাও। আর সফল পরিণতিতে দেখতে চাওয়া যে বঙ্গোপসাগরের চমৎকার মোহনায় গড়ে ওঠা চারটি সমুদ্রবন্দরের অধিকার থাকার সুবাদে বাংলাদেশের আগামী দিনের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তিও হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুরের মতোই বন্দর পরিচালনা থেকে লব্ধ আয়। আর বিষয়টি তখনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব, যখন বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতাই হবে মূল শর্ত ও অগ্রাধিকার। আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকরা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে গতানুগতিক চিন্তাভাবনা থেকে একটু একটু করে হলেও ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতার পথে এগোতে চেষ্টা করবেন এবং তাদের তা করতেই হবে এ কারণে যে আগামী দিনের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ব্যতিক্রমী হওয়া ছাড়া টিকে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই।


আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত;

সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

আরও