না, কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় যাচ্ছি না। সে আলোচনায় গিয়েও কোনো লাভ নেই মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়েই চলমান বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিক কচকচি দিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ দুর্ভোগ দূর করা যাবে না। মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে দুটো চিত্র আমাকে বড় বিচলিত করেছে। একজন আমাকে বাজারের মূল্যতালিকা পাঠিয়েছেন। সে তালিকায় কোনো মাছ-মাংস নেই, আছে শুধু শাকসবজি। সবগুলো সবজিরই প্রতি কেজির দাম ১০০ টাকার আশপাশে। টমেটো, গাজর, মরিচ, ধনেপাতার প্রতি কেজির মূল্য কমবেশি ২০০ টাকা। তালিকার শেষে তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমি কী করে আমার সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেব?’ অন্য চিত্রটি বড় করুণ। সেটি একটি সচল চিত্র, যেখানে জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্যের কথা বলতে গিয়ে একজন বর্ষীয়ান অবসরপ্রাপ্ত মানুষ কেঁদে ফেলেছেন, জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আমাদের মতো মানুষের কী হবে?
কী জবাব দেব এসব ব্যাকুল প্রশ্নের? এটা তো শুধু অর্থনীতির বিষয় নয়, নয় আর্থিক ‘হিসাবায়নের’। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ নাকি ১০ শতাংশ, তা নিয়ে তর্কের কি কোনো মানে আছে সেসব মানুষের কাছে, যাদের সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে গেছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে? কত ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে জিনিসপত্রের দরদাম বাড়ার, কত ব্যবস্থার কত কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী আসে যায় সেসব বিশ্লেষণের, যারা একটু খেয়েপরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।
আসলে দরদাম বৃদ্ধির কোনো ব্যাখ্যাই তো কাজ করছে না—না সামষ্টিক পর্যায়ে, না ব্যষ্টিক পর্যায়ে। সামষ্টিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপানো বন্ধ করেছে, টাকা পাচারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, বাইরে থেকে বাংলাদেশে শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। কিন্তু কোনো হেরফের হয়নি বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রীর উচ্চ মূল্যের। বলা হয়, সময়মতো আমদানি না করায় কিংবা আমদানি শুল্ক না কমানোয় দাম কমছে না। পেঁয়াজের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছিল, আমদানি বেড়েছে তার, কিন্তু পেঁয়াজের দাম কি কমেছে? আলুর দামও কি ঊর্ধ্বমুখী নয়? ডিমের দামও তো কমছে না, আমদানির পরও নয়, শুল্ক কমানোর পরও নয়। বর্তমানে ধনেপাতার দামও আকাশছোঁয়া। আমরা সবাই বলছি যে বন্যার কারণে আমাদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে পারে। নিশ্চয়ই বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে নানা পণ্যের দাম বাড়বে। কিন্তু যখন পণ্য উৎপাদন অঞ্চলেও অন্যান্য জায়গার মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হওয়ার কারণ থাকে বটে।
শঙ্কার কারণ রয়েছে অন্যত্রও। সাধারণ মানুষের সহজতর আমিষের উৎস হচ্ছে ডিম। কিন্তু এখন প্রতিটি ডিমের মূল্য প্রায় এক বোতল পানির কাছাকাছি। বলা হচ্ছে, পানির দরে ডিম বিক্রি হচ্ছে। আমার এক বন্ধু লিখেছে, ‘আমাদের ছোটবেলায় মধ্যবিত্ত পরিবারে আমরা ভাইবোনরা সপ্তাহে একটির বেশি ডিম খেতে পারতাম না। বর্তমান সময়েও আমরা সপ্তাহে একটার বেশি ডিম খেতে পারি না। আহা! শৈশবে ফিরে যাওয়া কী যে মধুর।’ এসবই পরিহাসের কথা, সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি।
বিভিন্ন রকমের চালের দামও বাড়ছে। জনসংখ্যার একটা বড় অংশই বাজার থেকে চাল কিনে খায়। বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামীতে বোরো মৌসুমে কৃষির উপকরণ সহজলভ্য না হলে চালসহ নানা কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বহু ক্ষেত্রেই পণ্যের জোগান ঘাটতির চেয়েও আনুপাতিকভাবে দাম বেশি বেড়ে যায়, সাধারণ মানুষের কাছে তা নিতান্ত কষ্টকর হবে।
দাম কমানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানো হবে না, সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, ঋণ উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, নানা গোষ্ঠীকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে ‘কঠোর ব্যবস্থার’ কথা বলে। সরকার খোলা বাজার ব্যবস্থায় ট্রাকে করে শাকসবজি বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির অশ্বকে বাগ মানানো যাচ্ছে না।
দরদামের ক্ষেত্রে নানা আশার বাণীও শোনানো হচ্ছে। ‘ছয়-সাত মাসের মাঝে দাম কমে আসবে’ এমনটা বলছেন সরকারি কর্মকর্তারা কিংবা ‘শীতকালীন সবজি উঠলেই সবজির দাম পড়ে যাবে’ এমন আশাবাদও শোনা যাচ্ছে। ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে’ এমনটাও বলা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ পরিসংখ্যানে উৎসাহী নয়, তারা পরিসংখ্যান জানতে চায় না, তারা আগামী দিনের আশাবাদও শুনতে চায় না। সাধারণ মানুষ চায় এখনই দাম কমতে শুরু করুক, এখনই তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। এমন প্রত্যাশা অযৌক্তিক কিনা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে এটাই বর্তমান সময়ের বাস্তবতা।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ উচ্চ মূল্যের শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সংযোগ নেই। উন্নত বিশ্বে যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশ, কানাডায় ১ শতাংশ। সব দেশই কভিড-সম্পর্কিত এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পৃক্ত উচ্চ মূল্য কমিয়ে আনতে পেরেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ভিন্ন অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম। দুই বছর আগেকার সংকট কাটিয়ে শ্রীলংকা তার ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে বর্তমান সময়ে ১ শতাংশের নিচে কমিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যহ্রাস হয়নি।
প্রথাগত কারণগুলো দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে তেল জ্বালানির মূল্য কমে এসেছে। বাংলাদেশেও তা কমে এসেছে, ফলে পরিবহন ব্যয় তো বাড়ার কথা নয়। মহাসড়ক অবরোধ নেই, টোল বাড়েনি। তবু দাম বাড়ছে। আমদানির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পণ্যের, শুল্কও কমানো হয়েছে, কিন্তু দামের পড়তি নেই। অনেকেই বলছেন, বাজারে তো পণ্যের কমতি নেই। তাহলে কেন এমনটা হচ্ছে? ‘উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীলতা’ বলে কি পার পাওয়া যাবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ওই ‘বানর ও তৈলাক্ত বাঁশের’ মতো। অতীতে একটা সময়ে মূল্যস্ফীতি ওই বানরের মতো ওই তৈলাক্ত বাঁশ ধরে ওঠা-নামা করেছে, তারপর একটা সময়ে এক লাফে বাঁশের মাথায় চড়ে বসেছে, আর তার নামার নাম নেই।
মূল্যস্ফীতি বিষয়ে যেসব যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান তা দিয়ে এ অবস্থা ব্যাখ্যা করা যচ্ছে না। সুতরাং হয়তো এর ব্যাখ্যা অন্য জায়গায় লুকিয়ে আছে। হয়তো যে কারণগুলো অযৌক্তিক, তার মধ্যেই। হয়তো বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কাঠামোগত অন্তরায় জড়িয়ে আছে সেই সিন্ডিকেট, সেই চাঁদাবাজি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কারের শ্লথতা, অন্তত আমার তা মনে হয়। এ প্রসঙ্গে হাসান মামুনের কথাটিই মোক্ষম ‘দাম বৃদ্ধির অযৌক্তিক কারণ চিহ্নিত করা হোক’। কথাটি মোটেই অযৌক্তিক নয়।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র