রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে যে ‘পাইলট প্রকল্প’ নেয়া হয়েছে, এটি কি আদৌ কোনো সমাধান দিতে পারবে? এ প্রশ্ন এখন বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে প্রতিনিধি দল আসার পর খোদ মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গারা যে দৃশ্য দেখে এসেছে, তার আলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো আশার আলো আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
মূলত চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার এ ‘পাইলট প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে এটি তৃতীয় দফা উদ্যোগ। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। সে সময় অবশ্য তারা রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ বলে
বর্ণনা করেছিল।
মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের মধ্যস্থতাতেই সেই চুক্তি হয়। তখন চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা উচিত। চীন চায় মিয়ানমারে যেন চীনের বন্ধুভাবাপন্ন একটি সরকার ক্ষমতায় থাকে। এজন্য অতীতে জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যেসব প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তাতে চীন বরাবর ভেটো দিয়েছে।
২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর কার্যকর হয়নি।
এরপর ২০১৯ সালের আগস্টে চীনের পক্ষ থেকেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সমাধান না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।
এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের তরফ থেকে এ তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে চলে আসার সময় যে গ্রাম রেখে এসেছিলেন, তার কোনো অস্তিত্ব দেখেননি বলে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন। সেখানে তারা সারিবদ্ধ ক্যাম্প দেখেছেন বলে জানান।
প্রত্যাবাসনের পরিবেশ দেখতে যাওয়া বাংলাদেশে বসবাসরত ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ প্রতিনিধি দল ৫ মে মিয়ানমার থেকে আসার পর এমন তথ্য জানিয়েছেন।
তারা মংডু শহরের আশপাশে কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন। সেখানে এখন গ্রামের কোনো অস্তিত্ব নেই। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সারি সারি ক্যাম্প তৈরি করেছে। এসব ক্যাম্পেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাখার পরিকল্পনা করছে।
বর্তমানে রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ এবং পরিস্থিতি কোনোটাই নেই। ছয় বছর আগে ফেলে আসা তাদের জন্মভূমিতে সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্ত চৌকিসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। মংডুতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য যে ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে থাকতে রোহিঙ্গারা রাজি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পেলে কোনো রোহিঙ্গাই রাখাইনে ফিরতে রাজি নয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে গেছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের এ ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের দাবি জানালেও প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে আপাতত নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। এনভিসি কার্ডে তাদের ক্যাম্পে থাকতে হবে। মিয়ানমারের এমন শর্তে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হবে এমন সম্ভাবনা কম। তবে মিয়ানমারের মংডু শহর পরিদর্শনকালে পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি দেখা গেছে। সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, ব্যবসা করা মানুষের ৮০ শতাংশই দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের। সেখানে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বস্তুত রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমি রাখাইনে পুনর্বাসন প্রত্যাশা করছেন। নাহলে তারা ফিরতে আগ্রহী নয়, এ রকম মনোভাব কি আদৌ সমস্যার সমাধান করবে? মিয়ানমারের সরকারের কারণে যেখানে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। সেখানে চীনের চাপে পড়ে হলেও আবার মিয়ানমারে ফেরত নিতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে বিষয়টি কি এ রকম নয়? এমন পরিস্থিতিতে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে আপেক্ষিক। যে সমস্যা এত দিনেও সমাধান হচ্ছে না, তা খুব সামান্য সময়ে যে সম্ভব হবে সেটা নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন শুরুর ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ছাড় দেয়াটা প্রয়োজন। আবার এ প্রত্যাবাসন যেন আগের মতো রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়া হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হলেও রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে যে পরিমাণ বিদেশী সাহায্য এসেছিল, তার পরিমাণও কমে গেছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ হলেও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তারা ক্যাম্পের বাইরে এসে ভুয়া এনআইডি, ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আটক হয়। ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের ঘটনাও ঘটে। মূলত রোহিঙ্গারা যে এ দেশে আশ্রিত সেটি তাদের জীবনাচরণে ফুটে ওঠে না। আবার তাদের মূলস্রোতে মিশে যেতে দেয়াও সম্ভব নয়। সে হিসেবে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনই আমাদের কাম্য। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার আন্তরিক নয়, এটি একতরফাভাবে বলা যাচ্ছে না। আবার রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ‘পাইলট প্রকল্প’ হিসেবে ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে আসলে আস্থার সংকটটি এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
কেননা ২০১৮ সালে মিয়ানমারের কাছে প্রত্যাবাসনের জন্য ৮ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছিল বাংলাদেশ। সে তালিকা যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল মিয়ানমার। তাই মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে। এক্ষেত্রে তার পরও সীমিত সংখ্যক হলেও যে পরিমাণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার ফেরত নিতে চাচ্ছে, কূটনৈতিকভাবে এ আন্তরিকতাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এর পরও যেহেতু বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যাবে, সে হিসেবে পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে বাকিদের ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতা বজায় রাখতে হবে। সেজন্য প্রথম ধাপে অন্তত এ ‘পাইলট প্রকল্প’ যেন সফল হয় সেজন্য সব পক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি।
তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক