সময়ের ভাবনা

পানি সরবরাহে ওয়াসার ভূমিকা ও অপচয় রোধ

পানি প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নাগরিকদের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটির (ওয়াসা) কার্যকর ভূমিকাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সুপেয় পানির ক্ষেত্রে ওয়াসার ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সর্বত্র পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও বারবার পানির দাম

পানি প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নাগরিকদের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটির (ওয়াসা) কার্যকর ভূমিকাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সুপেয় পানির ক্ষেত্রে ওয়াসার ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সর্বত্র পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও বারবার পানির দাম বাড়াচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। এমনকি পানির দাম নির্ধারণের বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এদিকে পানির দাম এলাকাভিত্তিক আলাদা করার বিষয়ে দুই বছর ধরেই বলা হচ্ছে। অবশ্য ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘ওয়াটার শুড হ্যাভ অ্যান অ্যাফোরডেবল প্রাইস’। সে বিবেচনায় ঢাকার গুলশান ও যাত্রাবাড়ীতে পানির দাম সমান হওয়া উচিত নয়। অভিজাত এলাকা এবং নিম্নবিত্তদের বসবাসরত এলাকায় পানির দাম এক হবে না—এটিই এ সিদ্ধান্তের অভীষ্ট লক্ষ্য। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে যৌথ পরামর্শের ভিত্তিতে পানির মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার পানির ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। অবশ্য এলাকাভিত্তিক দাম নির্ধারণে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দাম না বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু ভর্তুকির যে প্রশ্নটি আসছে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহের খোরাক রয়েছে। কারণ খোদ ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছরই সংস্থাটি মুনাফা করেছে। গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়ানোর ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয়ও বেড়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে ওয়াসার শতভাগ রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওয়াসা এমডির দাবি অনুযায়ী আগে রাজস্ব ৬৪ শতাংশ আদায় হতো। এখন শতভাগ আদায় হচ্ছে। এ রকম লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে যদি ভর্তুকির কথা বলা হয়, সেটি আমজনতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এদিকে বাংলাদেশে একই শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানির আলাদা দাম নির্ধারণের ঘটনা ঘটেনি। এখন এটি নিয়ে আলোচনা হলেও পানির অপচয় রোধ এবং ওয়াসার দুর্নীতি বন্ধের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ঢাকা ওয়াসা আইন ১৯৯৬-এ সুস্পষ্টভাবে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পানির মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো বিধি প্রণয়ন ছাড়াই খেয়ালখুশিমতো পানির মূল্যবৃদ্ধি এবং অবৈধভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ওয়াসার বিরুদ্ধে। বস্তুত সাশ্রয়ী দামে যদি পানি না কিনতে পারা যায় তাহলে সেটি একটি ব্যর্থতার নজির হবে। এজন্য কীভাবে পানি জনগণের কাছে সাশ্রয়ে পৌঁছে দেয়া যায় সেদিকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। 

ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দিনে ঢাকা ওয়াসা যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ ভাগ গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। বিষয়টি কাগজে-কলমে ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে পরিচিত। শুধু এ অপচয় কমাতে পারলেই বছর বছর ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না।

বর্তমানে ঢাকায় পানির দৈনিক চাহিদা কমবেশি ২৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা দৈনিক ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার দাবি করে। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সিস্টেম লস ২০ শতাংশ বাদ দিলে প্রতিদিন ৫২ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত যায় না; গ্রাহক পান ২০৮ কোটি লিটার। ফলে পানির ঘাটতি থাকছে। এ ধরনের সিস্টেম লসের পাশাপাশি অব্যবস্থাপনার বিষয়টিও রয়েছে। অর্থাৎ মিটার রিডিংয়ে কারসাজি ও অবৈধ লাইনের মাধ্যমে ওয়াসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর দায় পড়ছে ওয়াসার গ্রাহকদের ওপর। সবার জন্য সাশ্রয়ে পানি নিশ্চিত করতে হলে সিস্টেম লস কমানোর পাশাপাশি পানি চুরি ঠেকাতে হবে। 

এবার আসা যাক পানির সহজলভ্যতা ও নাগরিকদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে, পানি যে অফুরন্ত সম্পদ নয় সেটি আমরা ভুলে যাই। অর্থাৎ অপচয়ের ক্ষেত্রে পানিকে খুবই সস্তা উপকরণ মনে করা হয়। যে কারণে সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় অনেকেই বেসিনের কল ছেড়ে রাখেন। কাপড় ধোয়ার সময়ও কল বন্ধ রাখেন না। এক্ষেত্রে ঢাকার রাস্তার পাশের পানির কলেও প্রচুর পানি অপচয় হয়। অথচ পানি অপচয়ের সময় মনেই থাকে না যে মাঝেমধ্যে এক ফোঁটা পানিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে।

এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি অমূল্য সম্পদ হলেও এ পানি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে বাড়ছে ভূমিকম্পের শঙ্কা। দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির স্বাদ, রঙ, গন্ধ সবকিছুই বদলে গেছে। ঢাকা শহরের খাল-বিল, জলাশয়গুলোয় ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ভবন তৈরি করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিল্ডিং কোড অনুসারে দুটি ভবনের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা রাখার কথা বলা হয়েছে, সেটিও মানা হচ্ছে না। ফলে বৃষ্টির পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য যে প্রক্রিয়াটি দরকার, সেটি ব্যাহত হচ্ছে। 

অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে পানি সংকট নিয়ে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২৩-এ বলা হয়েছে, বিশ্বের ২৬ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না। গত চার দশকে বছরপ্রতি বিশ্বে পানির ব্যবহার ১ শতাংশ করে বেড়েছে। ২০৫০ সাল পর্যন্ত এ হার বজায় থাকতে পারে৷। অঞ্চলভেদে পানি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে বড় ব্যবধান আছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়৷। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মধ্য আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে যে পানির সংকট রয়েছে, সেটা আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বের এসব দেশের উদাহরণ থেকে আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।৷২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ। বর্তমানে বিশ্বে মোট পানি ব্যবহারের ৭০ শতাংশ কৃষি খাতে হচ্ছে,৷তবে অধিক জনসংখ্যার কারণে কৃষিজমি থেকে পানি সরবরাহ কমিয়ে শহরাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের ২৩০ কোটি মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষের সুপেয় পানি ব্যবস্থায় এখনো প্রবেশাধিকার নেই। এর মধ্যে আফ্রিকার মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ উৎস থেকে পানি পায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার উন্নত দেশগুলো পানি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করতে পারছে বলে পানি নিরাপত্তা সূচকে তারা এগিয়ে রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে পানির প্রতিবেশ সিস্টেম নষ্ট হলেও তারা আবার সেটিকে ফিরিয়ে এনেছে।

এসব দেশের পানি ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে ওয়াসার কার্যক্রম ঢেলে সাজানো উচিত। বিশেষ করে সুপেয় পানি নিশ্চিতে পানি শোধনাগার প্রকল্পগুলোকে সক্ষম করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাজধানীর আশপাশে চার-পাঁচটি নদী থাকা সত্ত্বেও ওয়াসা পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে পানি আনছে। এ কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ওয়াসার উচিত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও অন্যান্য কাছের নদীগুলোর দিকে নজর দেয়া। এতে খরচ কমবে এবং নদীগুলো থেকে সরকার দূষণ কমাতে বাধ্য হবে।

ওয়াসার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ফলে প্রকল্পগুলোয় মাত্রাতিরিক্ত খরচ দেখানো হচ্ছে। সরকারকে এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশে সুপেয় পানির সহজলভ্যতা থাকলেও মান ধরে রাখা প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে পানির পাশাপাশি স্যানিটেশনকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অতীতে সরকারি এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা গেছে। যেটি নগর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারোরই কাম্য নয়। অন্যদিকে কৃষিনির্ভর দেশ হওয়ায় সেচ ও দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বন্যা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিশেষে সুষম বণ্টন নিশ্চিতের মাধ্যমে আমরা পানির নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে পারব—এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।


তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও