আলোকপাত

জাতিসত্তা থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও জাতি গঠন

জাতি-নৃগোষ্ঠীর বিভ্রান্তি

জাতি ও জাতিসত্তা ধারণাগুলোর বহুমুখী ব্যাখ্যা রয়েছে। এসবের মাঝে ‘জাতীয়তা’, নৃগোষ্ঠী বা ‘জাতিত্ব’ (ethnicity) অথবা বর্ণের প্রলেপ মেশানো জাতি (race) ভিড় করায়, এ বিষয়ে পদ্ধতিসম্মত আলোচনা বেশ দুরূহ। যতদূর বুঝি, নিকট অতীতের (মাত্র বিগত পাঁচশ বছরে) ঔপনিবেশিক দখলদারদের দৃষ্টিতে, উপনিবেশ-ভূখণ্ডে অবস্থিত অনেক নৃগোষ্ঠীর মানুষকে দেখতে একই রকম মনে হতো। সাম্রাজ্য বিস্তারের একপর্যায়ে তারা, সম্ভবত একাধিক নৃগোষ্ঠীর জনসাধারণকে একত্রে একটি শাসিত জাতি গণ্য করতে শুরু করে। একইভাবে অনস্বীকার্য যে বিভিন্ন মহাদেশে সংগঠিত উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন, একক বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে নিজেদের মধ্যকার পার্থক্য ভুলে, জাতিরাষ্ট্র (nation state) প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ভেসেছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এক বা কয়েকটি জোটবদ্ধ শক্তিশালী নৃগোষ্ঠী অন্যান্য দুর্বল নৃগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য এনে একক জাতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এসব প্রক্রিয়ায় অনেকে একটি ‘জাতি’তে রূপান্তরিত হয়েছে বা হতে সচেষ্ট হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের এ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ পশ্চিমা জ্ঞানভাণ্ডারে সর্বাধিক দৃশ্যমান হয় নৃবিজ্ঞান পাঠে। সম্ভবত সে কারণেই নৃগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য তালিকায় পূর্বপুরুষ, বংশ, ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির বাইরে ধর্মকেও অনেক সময় অন্তর্ভুক্ত করা হয় (নেট সূত্রে)।

আগেই উল্লেখ করেছি, ধারণাগুলো এতই লেজেগোবরে জড়িয়ে আছে যে চেতনার জগতে জাতিসত্তা বা জাতিভিত্তিক আত্মপরিচয় সুসংবদ্ধ করা কঠিন। উপরন্তু বাইরের স্বার্থে ভৌগোলিক বিভাজন চাপিয়ে দেয়ার কারণে, দুর্বল সমাজ ও অর্থনীতির পক্ষে স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র গঠন করে অস্তিত্ব নিশ্চিত করা দুরূহ। বক্তব্যে স্বচ্ছতা আনার জন্য এবং সহজ-সরল আলোচনার স্বার্থে, আমি সুনির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের প্রতিটি নৃ-ভাষাগোষ্ঠীকে এক একটি জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা হিসেবে গণ্য করব, যেসব সত্তাকে ঘিরে সত্তা-সদস্যের অনেকেই আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এদের প্রত্যেকেরই হয়তো একসময় নিজেদের রাজত্ব (বা স্বাধীন বাসভূমি) ছিল, যা সুদূর অতীতে অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করেছে। জনসংখ্যার আকারভেদে এবং পুঁজি গঠনে ভিন্নতা থাকার কারণে, স্বক্ষমতায় এদের (সমকালীন) রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনায় হেরফের থেকেছে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে পশ্চিমা শক্তির উপনিবেশ হওয়া বা না-হওয়া ভূখণ্ডে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতি গঠনের ধারায় ভিন্নতা থেকেছে। প্রথমটির ক্ষেত্রে (অর্থাৎ এককালীন উপনিবেশে) প্রতিক্রিয়াধর্মী জাতীয়তাবাদের উত্থান অধিক পরিলক্ষিত। এর বিপরীতে, যেসব ভূখণ্ড উপনিবেশ হওয়া থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে, সেখানকার প্রভাবশালী (বা প্রতাপশালী) গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে অন্যদের নিয়ে জাতিগঠনের প্রচেষ্টা থেকেছে। উভয় ক্ষেত্রেই, ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিবেশে, ‘জাতিরাষ্ট্র’ গঠনের তাগিদ অধিক পরিলক্ষিত। তবে ভাঙাগড়ার খেলা যেখানে স্থিতি পায়নি, (অপরিণত) রাষ্ট্রের পরিসীমার অভ্যন্তরে অবস্থিত আন্তঃসীমান্তীয় নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে বহিঃশক্তির বিভাজনের প্ররোচনা লক্ষ করা যায়। সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অগ্রজ গোষ্ঠীর মাঝে, পারস্পরিক সমঝোতায় অথবা দুর্বলদের অবমিত রেখে, জাতি ও সবল জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ করা যায়।

শেষোল্লেখিত প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে আলোচনা করব। তবে আত্মপরিচয় (সত্তা) সুদৃঢ় করতে অন্তর্ভুক্তিতার গুরুত্ব আছে। তাই কিছুটা বিমূর্তভাবে, শুরুতে ‘জাতি’ কথাটি থেকে বিযুক্ত করে, সত্তা-অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন প্রয়োজন। সত্তা ও অন্তর্ভুক্তি ধারণা দুটো পরস্পর-নির্ভরশীল এবং জাতি গঠনের আলোচনায় মৌলিক উপাদানের ভূমিকা রাখে। চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যের আলোকে নিবন্ধের শেষাংশে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতি গঠনে ‘বৈষম্যবিরোধী’ বা ‘বৈষম্যহীন’ স্লোগানের পরিবর্তে ‘পরস্পর-নির্ভরশীল’ অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা খুঁজব।

সত্তা, আত্মপরিচয় ও অন্তর্ভুক্তি-পরিত্যাজ্যের (inclusion-exclusion) দ্বন্দ্ব

জ্ঞানচর্চায় তথ্যকে নির্দিষ্ট ছকে (প্যাটার্ন) সাজানোর চল বহুকালের। পরিসংখ্যানবিদ্যায় ও অর্থনীতিবিদ্যার অর্থমিতিতে (ইকোনমেট্রিক্সে) পড়ানো ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে এক বা একাধিক গুচ্ছকরণ সম্ভব। এসব গুচ্ছের প্রতিটিকে আমরা পৃথক সত্তা (শ্রেণী বা গুচ্ছ) হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। মানব সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে সত্তা ধারণাটি অধিক প্রযোজ্য, তাই এ অংশের আলোচনায় সে ধারণাটিই ব্যবহার করব। সত্তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য (properties) লক্ষণীয়:

১. সত্তা কোনো স্থির ধারণা নয়। কোন চলকগুলো ব্যবহার করে গুচ্ছ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে তার ওপর গুচ্ছ নির্ণয় নির্ভর করবে। অর্থাৎ আমরা মানুষের বর্ণ, ভাষা ও ধর্ম ব্যবহার করছি, নাকি ভাষা, গড়ন ও খাদ্যাভ্যাস চলকগুলো ব্যবহার করছি তার ওপর নির্ভর করবে উল্লেখ করার মতো কয়টি সত্তা একটি সমাজে আছে এবং সেসবের গঠনে কোন চলকগুলো মুখ্য ভূমিকা রাখে।

২. একটি সত্তার পরিবর্তনশীলতার ভিন্ন কারণও রয়েছে। যেসব চলকের ভিত্তিতে একটি সত্তা নির্ধারিত হয়, তা একক (মানুষ)-এর ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে, যার ফলে সত্তার পরিবর্তন ঘটতে পারে। সুদীর্ঘ অতীতে ধর্মের ক্ষেত্রে আমরা এ পরিবর্তন লক্ষ করেছি। নিকট অতীতে, নাগরিকত্ব পরিবর্তন (বা তথাকথিত দ্বৈত নাগরিকত্ব) সমগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন।

৩. সত্তা নির্ধারণে ব্যবহৃত গুচ্ছ বিশ্লেষণে মূলত ANOVA বা Analysis of Variance (বৈষম্যের বিশ্লেষণ) নীতি অনুসরণ করা হয়। গুচ্ছ বা সত্তাগুলোকে এমনভাবে বাছাই করা হয় যেন সত্তার অভ্যন্তরের পারস্পরিক পার্থক্য (দূরত্ব) কম এবং একটি সত্তা থেকে অন্য সত্তার দূরত্ব সর্বাধিক নিশ্চিত করা হয়। স্বীকার করতে হবে যে সত্তা নির্ধারণের এ প্রক্রিয়ায়, একদিকে যেমন প্রতিটি সত্তা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, তেমনি, অন্যান্য সত্তা থেকে দূরত্ব (বা পার্থক্য) সৃষ্টি করে তা বর্জনধর্মী এবং বৃহত্তর সমগ্রে (সমাজ, অঞ্চল বা পৃথিবীতে) পরিত্যাজ্যের মাত্রা বৃদ্ধি করে।

ওপরের আলোচনা থেকে প্রথম সাধারণ উপসংহার হলো:

একটি সত্তার বিকাশ ঘটে যদি তার অভ্যন্তরের অন্তর্ভুক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তবে একই প্রক্রিয়ায়, বৃহত্তর পরিসরের (নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বা সমাজে) সম্ভাব্য অন্যান্য সত্তা থেকে এর পার্থক্য স্পষ্ট করতে হয়। অর্থাৎ সমাজে একটি সত্তাকে দৃঢ় করার প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর পরিসরে পরিত্যাজ্যের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, বা অন্তর্ভুক্তিমূলকতা হ্রাস পায়।

আমরা যখন নীতি পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তি কর্মসূচির কথা বলি, তখন পরোক্ষভাবে স্বীকার করি যে অনেকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত বা অন্তর্ভুক্ত নয়। যেসব কারণে তারা মূলধারার বাইরে (পরিত্যাজ্য) রয়েছে, তা চিহ্নিত করার পরই অন্তর্ভুক্তির কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন সম্ভব। এসব বিষয়ে আগেকার গবেষণায় সেবা-বাজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত বা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পৃথককৃত (differentiated) সেবা বা দ্রব্যের আশ্রয় নিতে হয় (Springer থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত Marginality Addressing the Nexus of Poverty, Exclusion and Ecology বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে “Exclusion and Initiatives to ‘Include’: Revisiting Basic Economics to Guide Development Practice” শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য)। এর দৃষ্টান্ত দেখা যায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। যেমন সবাইকে শিক্ষা দিতে গিয়ে আমরা ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক বাজারের কাছে ধরা খেয়ে নানা স্তরের ‘শিক্ষিত’ সৃষ্টি করেছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় সাধারণ উপসংহার:

অন্তর্ভুক্তিমূলকতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো সত্তার অভ্যন্তরের স্তরবিন্যাস বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ যে অন্তর্ভুক্তিমূলকতা একটি সত্তাকে সুসংবদ্ধ হতে সহায়তা করে, সেই একই প্রক্রিয়া সত্তার অভ্যন্তরে শ্রেণীবিন্যাস বৃদ্ধি করে ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বপন করে।

বৈষম্যহীনতা বনাম পরস্পর-নির্ভরশীলতা

যে বিষয় নিয়ে এ অংশে আলোচনা করব তা শুরুতেই প্রস্তাব হিসেবে নিম্নে উল্লেখ করলাম,

বৈষম্যহীন সমাজ একটি স্বপ্ন, যা অদূরভবিষ্যতে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রতিকূল পৃথিবীতে সম্মানজনক অস্তিত্বের জন্য, অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন সমাজগোষ্ঠীর (সত্তার) পরস্পর-নির্ভরশীল আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

সামষ্টিক অর্থনীতির অতিপরিচিত IO-SAM বিশ্লেষণ কাঠামোর সূত্র ধরে উপরোক্ত প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দেব। ইনপুট-আউটপুট (IO) সারণি থেকে আমরা দেশে উৎপাদিত সব পণ্যদ্রব্য ও সেবা তৈরি করতে বিভিন্ন উপকরণ ও শ্রম ব্যবহারের বর্ণনা পাই, যা বিবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আন্তঃসম্পর্ক (inter-industry)-এর চিত্র দেয়। সময়ের বিবর্তনে চাহিদার ধরন পাল্টায় এবং প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কর্মকাণ্ড এবং অনেক ধরনের শ্রম অপাঙ্‌ক্তেয় হতে পারে। নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তনের ফলে ভিন্ন দক্ষতার শ্রম চাহিদা বাড়তেও পারে। এসব বুঝতে এ সামষ্টিক উৎপাদন কাঠামো (IO) অনেক সহায়ক। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন (পূর্বনির্ধারিত) আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা থাকে এবং বিভিন্ন প্রকারের আয় (মজুরি/বেতন, খাজনা, মুনাফা, ইত্যাদি) থেকে সেসব জনগোষ্ঠীর প্রাপ্তি সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিং ম্যাট্রিক্স (SAM)-এ সন্নিবদ্ধ করা হয়। এমনকি গোষ্ঠীভিত্তিক সেই আয় কোন ধরনের ভোগে বা সঞ্চয় ও বিনিয়োগে ব্যয় হচ্ছে সেসব তথ্য (ব্যয় হিসাব/ব্লক নামে কথিত) ব্যবহার করে অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড সঞ্চালনে বিবিধ নীতির প্রভাব বিশ্লেষণ সম্ভব।

একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে IO-SAM বিশ্লেষণে দুই ধরনের অন্তর্ভুক্তির ইঙ্গিত রয়েছে—উৎপাদনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ও পুনর্বণ্টন থেকে প্রাপ্তির মাধ্যমে। উপযুক্ত মালিকানা স্বত্ব চিহ্নিত করে তার ওপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টেকসই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ভালো হতো। সেই ধরনের ব্যবস্থায়, উৎপাদন থেকে প্রাপ্ত লাভ/মুনাফার অথবা খাজনার দাবিদার হয়ে অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। সেটার অবর্তমানে, উৎপাদনে শ্রমের প্রত্যক্ষ অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার পথটিই সর্বাগ্রে ভাবতে হয়। এর বাইরে IO-SAM বিশ্লেষণ কাঠামোয় সরকারি রাজস্বপ্রাপ্তি ও তা থেকে পুনর্বণ্টনের সম্ভাবনা সম্পর্কে যেমন ধারণা দেয়, তেমনি বেসরকারি/ব্যক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত পুনর্বণ্টনের পরিধি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। মালিকানা স্বত্বের বাইরে, অন্তর্ভুক্তির দুটো মূল পথের মাঝে, নিঃসন্দেহে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্মানজনক কর্মসংস্থানই অধিক কাম্য, যদি তা দীর্ঘস্থায়ী (টেকসই) হয়।

কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির দ্বিতীয় একটি ধারা আছে। প্রাথমিক আয়কারীদের ব্যয় থেকে বাজারে যে চাহিদা সৃষ্টি হয়, তা মেটানোর জন্য দ্বিতীয় পর্বের কর্মযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এর গতিপ্রকৃতি ভিন্ন এক নিবন্ধে আলোচনা করেছি। এখানে শুধু উল্লেখ করব যে অর্থবানদের চাহিদা বহুলাংশে সেবা খাতে হওয়ার ফলে সমাজ-সংগঠনে এর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব থাকে। পরস্পর-নির্ভরশীলতার এটা একটি উল্লেখজনক উদহারণ। ধনীরা যেমন নিরাপত্তাকর্মী, গৃহকর্মী, গাড়ির চালক ইত্যাদি সেবার ওপর নির্ভরশীল, অবস্থার বিপাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকে এসব কাজের জন্য ধনীদের ওপর নির্ভরশীল। তবে এ জাতীয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেবা বহুলাংশেই সম্মানজনক নয় এবং গণতান্ত্রিক চর্চা এগিয়ে নেয়ার পরিপন্থী।

পরস্পর-নির্ভরশীলতার অন্য একটি উদাহরণ হলো ভোক্তা ও স্থানীয় উৎপাদকের মধ্যকার যোগসূত্রতা। রেমিট্যান্স ও রফতানি থেকে প্রাপ্ত এবং স্থানীয় প্রাথমিক উৎপাদন থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে উদ্ভূত চাহিদা স্থানীয় উৎপাদন দ্বারা মেটাতে সক্ষম হলে সমাজের বন্ধন বৃদ্ধি পায়। ব্যয় হিসেবের তথ্য (ব্লক) এসব ক্ষেত্রে কর্ম-নির্দেশনার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সংক্ষেপে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

১. উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্মানজনক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা উত্তম। অনুমান করছি যে উপার্জনকারী ব্যক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী তার পরিবার ও সমাজের অন্যদের দেখভাল করবেন।

২. অর্জিত আয় যদি স্থানীয়ভাবে ব্যয় হয় তা স্থানীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক, যা ভোক্তা ও উৎপাদকের মাঝে পরস্পর-নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে সমাজ ও অর্থনীতিকে অধিক সংঘবদ্ধ করবে। দেশজ উদ্যোগে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করে বাহ্যিক চমক সৃষ্টি না করলেও বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের সমস্যা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেরা ভেবে সমাধানের পথ খোঁজা শুরু হলে পরিবর্তনের আশা জাগ্রত থাকবে।

৩. মালিকানা স্বত্বের টেকসই পরিবর্তন আনতে না পারলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা অধরা রয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে মালিকানার নানা রূপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। তবে অস্তিত্বের তাগিদে অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প নেই এবং তার সঙ্গে সমাজে স্তরবিন্যাস বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক গণ্য করতে হবে।

৪. দেশের বাইরে অর্থ পাচার হলে ভোগ ও সম্পদ সহজে দৃশ্যমান হয় না। অথচ দেশের অভ্যন্তরে আয় ব্যবহৃত হলে সমাজে বৈষম্য অধিকমাত্রায় অনুভূত হতো। তবে সেই ভোগের বণ্টনের ওপর তার তাৎপর্য নির্ভর করবে। অধিক অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আমদানি বৃদ্ধি পেতে পারে, স্থানীয় উৎপাদন বাড়তে পারে, পরিশীলিত ও সংগঠিত সেবা খাত বিকাশের সুযোগ পেতে পারে, অথবা দাসত্বসুলভ সেবা খাতের স্থায়িত্ব আসতে পারে। পরস্পর সহযোগিতামূলক সামাজিক চুক্তি কাদের মাঝে রচিত হবে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে সমাজের আদল পাল্টে গতিশীলতা আসবে, নাকি জড়তা সামাজিক অগ্রগতিকে রুদ্ধ করবে।

৫. সম্মানহানিকর অন্তর্ভুক্তি এড়াতে হলে পরিমিত বৈষম্যকে স্বাভাবিক গণ্য করে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর-নির্ভরশীলতা গড়ে তোলার প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

জাতিসত্তা, জাতিরাষ্ট্র ও জাতি: নাগরিকত্বের অপরিহার্যতা

বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে বহিঃশক্তির শাসনের সঙ্গে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। সেই তুলনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক মিলন প্রক্রিয়ায় সহজাত বিভেদের উপাদান এবং সেসব পেরিয়ে সত্তার বিকাশ অর্জনের ওপর আলোচনা অনুপস্থিত। এ নিবন্ধে দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছি এবং শেষ করব বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও জাতি গঠন সম্পর্কে সাধারণ কিছু মন্তব্য দিয়ে। আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোই লেখকের মুখ্য উদ্দেশ্য।

এ আলোচনায় ‘জাতি’ ধারণাটি জাতিরাষ্ট্রের পর্যায়ে ভাবা হয়েছে এবং ঐতিহাসিকভাব গড়ে ওঠা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা নৃ-ভাষাগোষ্ঠীকে জাতিসত্তা আখ্যা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক বা একাধিক জাতিসত্তা, তা সমগ্র বা আংশিক হোক, একত্রে মিলিত হয়ে জাতিতে রূপ নিতে পারে। বিশ্লেষণ কাঠামোয় উপজাতির যেমন স্থান নেই, একইভাবে ক্ষুদ্র-বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর অথবা আদিবাসীর আলোচনা অবান্তর।

প্রথম পর্বের আলোচনার সূত্র ধরে বলব,

১. একক নৃ-ভাষাগোষ্ঠী-ভিত্তিক জাতি গঠনের সম্ভাবনা বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কল্পনাতীত। প্রথমত, রাষ্ট্র গঠনে একক জাতিসত্তার বিষয়টি অবহেলিত ছিল এবং থেকেছে। সেই সঙ্গে এ এলাকায় ঐতিহাসিকভাবে, নানা জাতিসত্তার সহাবস্থান থেকেছে এবং বাংলাদেশ ভূসীমা তার ব্যতিক্রম নয়। দ্বিতীয়, সংকরত্ব মেনে নিয়ে বাঙালিকে নৃ-ভাষাগোষ্ঠী গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের আন্তঃসীমান্তীয় (ট্রান্স-বাউন্ডারি) অবস্থান আজ সন্দেহাতীত। একই বৈশিষ্ট্য গারো, ত্রিপ্‌রা, মণিপুরি, কুকিচিন প্রমুখ নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২. সত্তা নির্ণয়ে ধর্ম যোগ করলে বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীতে বহুমাত্রিক সত্তা চিহ্নিত করা যায়, এমনকি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও। বিভিন্ন কারণে জাতীয় পুঁজির বিকাশ ব্যাহত হওয়ায় সংস্কৃতির বেড়াজাল বহিঃশক্তির ইন্ধনে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

৩. কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের জন্য সংগতিপূর্ণ ‘জাতি’-ধারণা আবশ্যিক। এবং তা অর্জনের নামে ‘রাজনৈতিক দলের ঐক্য’ অথবা নির্বাচন পদ্ধতির বা সংবিধানে সংস্কারের প্রলেপ যথেষ্ট নয়। সেই রাষ্ট্রের অধীন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন উল্লেখজনক জাতিসত্তার মধ্যে ‘সামাজিক চুক্তি’র রূপরেখা রচনা অধিক জরুরি।

৪. বিভিন্ন জাতিসত্তার মাঝে সমঝোতাভিত্তিক জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ বাইরের স্বার্থের ধারক-বাহকদের উপস্থিতিতে বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এক সত্তার অধীনে বাকিদের জোরপূর্বক অবমিত করে অনেক ক্ষেত্রে জাতিরাষ্ট্র গঠনে তাড়াহুড়ো দেখা যায়। এ দ্বিমুখী প্রবণতার বাস্তবতা অনস্বীকার্য এবং সব পক্ষকে সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করা জরুরি।

আগেই বলেছি যে রাষ্ট্র গঠন ও (রাষ্ট্রভিত্তিক) জাতি গঠন অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন উল্লেখযোগ্য জাতিসত্তাগুলো চিহ্নিত করা, যার মধ্যে সংকর বাঙালিসহ অনেক নৃ-ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের অনেকগুলোয় ধর্মভিত্তিক বিভাজনও রয়েছে, যা জাতিসত্তা নির্ধারণে গুরুত্ব রাখে। বিবিধ মিশ্রণে গড়ে ওঠা এসব জাতিসত্তা নিয়ে একটি রাষ্ট্র ও জাতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তাদের মধ্যে টেকসই সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সমঝোতা সৃষ্টির পেছনে যে পরিমাণ সময় ক্ষেপণ হয়েছে, সেই তুলনায় জাতি ও রাষ্ট্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একত্রে চিহ্নিত করায় আমরা গুরুত্ব দিইনি। বিশেষত বিভিন্ন জাতিসত্তার চাওয়া-পাওয়া গুনতিতে এনে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মানজনক সহাবস্থানের শর্তাবলি চিহ্নিত করা ও সেসব বিষয়ে একমতে পৌঁছা আবশ্যক।

আগের বিশ্লেষণের সূত্র ধরে বলব যে জাতি গঠন অন্তর্ভুক্তিমূলক হলেও রাতারাতি বৈষম্যহীন হবে না। সবাই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন থাকাটা বেশি জরুরি। একই সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অনিবার্য কারণে পরিপূর্ণ সমতার ভিত্তিতে সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা না করা গেলেও শক্তিধরদের নিজ স্বার্থে নিশ্চিত করা প্রয়োজন যেন দুর্বলদের সম্মানজনক অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা। এসব কার্যকর করার জন্য পরোপকারে ইচ্ছুক পেশাগতভাবে যোগ্য ও যুক্তিসম্পন্ন একদল দেশপ্রেমীর প্রয়োজন, যারা বিভিন্ন জাতিসত্তাকে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

যারা চালকের ভূমিকায় রয়েছেন তাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে বিগত অর্ধশতাব্দীর অবহেলায়, রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের স্বাভাবিক পথগুলো বন্ধপ্রায়। অথচ যেসব জনগোষ্ঠী এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে আজ তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। তবে জনগোষ্ঠীর মাঝে রাষ্ট্রকে সুচিহ্নিত করতে চাইলে নাগরিকত্ব নির্ণয় আবশ্যিক। নাগরিকের মূল তালিকায় এ ভূখণ্ডের অনেক সন্তান, যারা অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা যেমন বাদ পড়বেন, তেমনি যারা স্বেচ্ছায় ভিনদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন অথবা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে ভিনদেশে দীর্ঘকালীন নিবাস বেছে নিয়েছেন তাদের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ রাখা বাঞ্ছনীয়। নিঃসন্দেহে উভয় গোষ্ঠীর জনগণকে বিশেষ সুবিধার আওতায় আনা যেতে পারে। তবে তা হওয়া উচিত উপযুক্ত নিবন্ধীকরণের পর। এ বিষয়ের দ্রুত মীমাংসা না হলে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের অন্যান্য জরুরি কাজে হাত দেয়া অর্থহীন। এ প্রক্রিয়া শুরু হতে বিলম্ব হলে রাষ্ট্রবিহীন শকুনের আস্তানা হওয়ার পরিণতি থেকে এ ভূখণ্ডকে রক্ষা করার পথ থাকবে না।

সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)

আরও