অভিমত

অপুষ্টি মোকাবেলায় জিংকসমৃদ্ধ চাল

বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখলের গৌরব অর্জন করেছে। জাতির জন্য নিঃসন্দেহে এটা এক বিশাল অর্জন ও গর্বের বিষয়। দেশ আজ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অদ্যাবধি শতাধিক উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে

বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখলের গৌরব অর্জন করেছে। জাতির জন্য নিঃসন্দেহে এটা এক বিশাল অর্জন গর্বের বিষয়। দেশ আজ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে কোটি ৮৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অদ্যাবধি শতাধিক উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ছয়টি জাত বায়োফর্টিফাইড জিংকসমৃদ্ধ। জাতগুলো হলো ব্রি ধান-৬৪, ব্রি ধান-৭২, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৪, ব্রি ধান-১০০ ব্রি ধান-১২০। প্রচলিত উচ্চফলনশীল ধানের  জাতগুলোয় গড়ে জিংকের পরিমাণ ১৫ থেকে ১৬ গ্রাম হলেও নতুন উদ্ভাবিত জিংকসমৃদ্ধ জাতগুলোর প্রতি কেজি চালে থেকে ১১ শতাংশ বেশি জিংক রয়েছে। ছয়টি জাতের মধ্যে আমন মৌসুমে চাষ হয় ব্রি ধান-৭২ বাকি পাঁচটি জাতের চাষ হয় বোরো মৌসুমে। ব্রি ধান-৭২ জাতের প্রতি কেজি চালে ২২ দশমিক কেজি জিংক থাকে। জাতটির হেক্টরপ্রতি গড় ফলন টন এবং নভেম্বরের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে কেটে আগাম আলু, সরিষা শীতকালীন সবজির চাষ করা যায় সহজেই।

মানবদেহের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জিংক অতি প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। শরীরের চালিকাশক্তির প্রায় ১০ শতাংশ প্রোটিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জিংকের ওপর নির্ভরশীল। এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তেমনি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে প্রভাবিত করে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ে জিংকস্বল্পতায় ভোগে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিংকের যে দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা করোনা মহামারীতে পৃথিবীর মানুষ এবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। জিংক ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ভাইরাসের নিজস্ব প্রতিলিপি তৈরিতে বাধা দেয়। শ্বেত রক্তকণিকা লিম্ফোসাইটস শরীরের দুটি মূল্যবান রোগ প্রতিরোধকারী কোষ। জিংক এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিপক্বতা, বিস্তার কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে।

জিংক মানুষের শরীরকে শক্তিশালী করার জন্য খুব উপকারী। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, ক্যান্সারের কোষ ধ্বংসে কাজ করে। জিংক শ্বাসকষ্টের সমস্যা হ্রাস করে। ম্যালেরিয়া অন্যান্য পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। জিংক হাঁপানি ব্রণের সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শিশুদের ডায়রিয়া উপশমে সহায়তা করে। এছাড়া সর্দি-কাশির মতো সাধারণ সমস্যায় জিংক কার্যকর বলে প্রমাণিত। ক্ষুধামান্দ্য, স্বাদহীনতা, ত্বকের রোগ, প্রজনন ব্যাহত হওয়ার পেছনেও জিংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জিংকস্বল্পতা স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি মানসিক বিকাশের পথে অন্যতম বাধা। জিংকস্বল্পতার কারণে শরীরে জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি, যেমন টি-সেল ন্যাচারাল কিলার সেলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা নিউমোনিয়ার মতো সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

একজন পুরুষ নারীর দৈনিক যথাক্রমে ১১ মিলিগ্রাম জিংক প্রয়োজন। অন্তঃসত্ত্বা সন্তানকে দুধ দানকারী মায়েদের জিংকের চাহিদা আরো বেশি। জিংকের অন্যতম উৎস হলো সামুদ্রিক মাছ অন্যান্য খাবার। যেমন কাঁকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, মাংস, দুধ, ডিম, দুগ্ধজাত খাবার, বাদাম, শিম, মাশরুম ইত্যাদি।

ব্রি ধান-৬৪ বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী প্রথম জিংকসমৃদ্ধ জাত। এর প্রতি কেজি চালে ২৪ মিলিগ্রাম জিংক রয়েছে। জীবনকাল ব্রি-২৮ অপেক্ষা পাঁচ থেকে ছয়দিন বেশি। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন দশমিক টন। জাতের চাল মাঝারি মোটা এবং ভাত ঝরঝরে। ব্রি ধান-৭৪-এর জীবনকাল ব্রি ধান-৬৪-এর চেয়ে চার থেকে পাঁচদিন কম। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন দশমিক টন। জাতে জিংকের পরিমাণ ২৪ দশমিক মিলিগ্রাম/কেজি।  ব্রি ধান-৮৪ বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য আর একটি জিংকসমৃদ্ধ জাত। এর জীবনকাল ১৪২ দিন। চালের আকার-আকৃতি ব্রি-২৮-এর মতো। জাতের চালে উচ্চমাত্রায় জিংক, মধ্যম মাত্রায় আয়রন প্রোটিন রয়েছে। প্রতি কেজি চালে জিংক আয়রনের পরিমাণ যথাক্রমে ২৭ দশমিক ১০ মিলিগ্রাম। ফলে জাতের চাল শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ ডায়রিয়া দূরীকরণে এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ উপকারী। ব্রি ধান-১০০, এটিও বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য জিংকসমৃদ্ধ জাত। জাতটির প্রতি কেজি চালে ২৫ দশমিক ৭০ গ্রাম জিংক রয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলন দশমিক ৬৯ টন। আশার কথা, সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য ব্রি ধান-১০২ নামের আরো একটি সম্ভাবনাময় জিংকসমৃদ্ধ নতুন ধানের জাতের অনুমোদন দিয়েছে। জাতের প্রতি কেজি চালে ২৫ দশমিক গ্রাম জিংক রয়েছে। আর নতুন উদ্ভাবিত জাতটির হেক্টরপ্রতি গড় ফলন দশমিক ১১ টন।

দানাশস্য, শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এখন আমাদের প্রয়োজন হলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশে মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ, প্রায় সাড়ে ছয় কোটি লোক জিংকস্বল্পতায় ভুগছে। আমরা গড়ে দৈনিক প্রায় ৪০০ গ্রাম চালের ভাত খাই। তাই জিংকসমৃদ্ধ চালের মাধ্যমে মানবদেহে এর ঘাটতি পূরণের একটি উত্তম সুযোগ রয়েছে। জানা যায়, জিংকসমৃদ্ধ চালের মাধ্যমে ৪০ শতাংশ জিংকের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

দেশে শিশুদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ এবং থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের জিংকের স্বল্পতা রয়েছে। আর গর্ভবতী নন দুগ্ধ দান করেন না, এমন নারীদের মধ্যে জিংকের স্বল্পতা ৫৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রচলিত উচ্চফলনশীল ধানের জাতে গড়ে ১৫ থেকে ১৬ গ্রাম/কেজি এবং বায়োফর্টিফাইড জিংকসমৃদ্ধ জাতে ২৪ থেকে ২৭ গ্রাম/কেজি জিংক রয়েছে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয়, একশ্রেণীর মিল মালিক ব্রি উদ্ভাবিত এসব চাল কাটিং পলিশিংয়ের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট করে মিনিকেট নাজিরশাইল নামে বাজারজাত করে দেশের ভোক্তাসাধারণকে প্রতারিত করছেন। যদিও দেশে মিনিকেট নামের কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। আর কম ফলনের কারণে আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেই নাজিরশাইল ধানের আবাদ উঠে গেছে। একসময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে নাজিরশাইল ধানের চাষ হতো। নাজিরশাইল চালের ভাত ছিল বেশ চিকন, সুস্বাদু ঝরঝরে।

মোটা মধ্যম মোটা চালকে কাটিং পলিশিং করে চিকন চাল তৈরির এই অশুভ কর্মকাণ্ডের ফলে চালের পুষ্টি উপাদানের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে এবং এর ফলে জনস্বাস্থ্যে কী প্রভাব পড়ছে তার ওপর গবেষণা করা এখন সময়ের দাবি। ধান বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মিল মালিকদের এই অপকর্মের কারণে ভোক্তা একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অপুষ্টি সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে; যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে আমাদের শিশু-কিশোরদের মেধা, মনন সুস্বাস্থ্যের ওপর। জাতীয় স্বার্থে বিষয়টিকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

ব্যাপারে প্রখ্যাত কৃষি অর্থনীতিবিদ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলমের বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তার মতে, চাল ছাঁটাই পলিশিংপূর্বক আকর্ষণীয় করে মিল মালিকরা প্রতারণা করছেন। চাল কাটিং করে মিল মালিকরা চিকন করছেন। এতে চাল থেকে অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান চলে যায়। একটি বিকাশমান অর্থনীতিতে এমন প্রতারণা মানা যায় না। কোন জাতের চাল, বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে মিলগুলো নিজেদের মতো ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বাজারে মিনিকেট নাজিরশাইল বলে চালু হওয়া চালের কোনো জাত না থাকলেও কোম্পানিগুলো বাড়তি লাভের আশায় প্রতারণা করছে। আইন করে যেমন লবণে আয়োডিন এবং তেলে ভিটামিন- থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তেমনি চালের ক্ষেত্রেও আইন করা দরকার।

বাংলাদেশের জিংকসমৃদ্ধ ধানের ২৫ শতাংশ উৎপাদন হয় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। ভবিষ্যতেও জিংকসমৃদ্ধ ধান উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে অঞ্চলটিতে। এতে একদিকে যেমন ক্ষুধা দারিদ্র্য দূর হবে, অন্যদিকে পুষ্টিহীনতা থেকে বাঁচা সম্ভব হবে বলে মনে করেন দেশের  কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ২০২০-২১ বছরে লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি ধান-৭৪-এর চাষ হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলায় ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। বরিশাল বিভাগের মধ্যে ভোলায় সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৯৬ হেক্টর জমিতে ধানের  আবাদ হয়েছে, যা বিভাগের মধ্যে ৬০ শতাংশ। ভোলায় জিংকসমৃদ্ধ ধান বেশি উৎপাদন হয়। নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে যদি ভোলা থেকে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ করা যায় এবং শিশু নারীদের মধ্যে যারা ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের চাহিদা মেটানো যায়, তাহলে জিংকস্বল্পতার ঘাটতি কিছুটা হলেও মোকাবেলা এবং কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ভোলা ছাড়াও যে জেলায় জিংকসমৃদ্ধ ধান বেশি হয়, সেখান থেকে অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করতে হবে। এতে বেসরকারি উৎপাদকরা উৎপাদনে এগিয়ে আসবেন। বীজ উৎপাদন চাহিদা বাড়বে। পুষ্টি আটার মতো জিংকসমৃদ্ধ চালকে পুষ্টি চাল নামে অভিহিত করা যেতে পারে।

শুধু চালের মাধ্যমে জিংক সরবরাহ করা যাবে বিষয়টি তেমন নয়। তবে যেহেতু দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল সেহেতু এর মাধ্যমেই মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় জিংকের একটি বড় অংশ সরবরাহ করা সম্ভব। এজন্য জিংকসমৃদ্ধ ব্রি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। ভোক্তাদের মধ্যে চালের চাহিদা বাড়াতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত জিংকসমৃদ্ধ চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের ধানচাল সংগ্রহ নীতিমালায় জিংকসমৃদ্ধ চালের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে জিংকসমৃদ্ধ ধানের বীজ বিতরণ করতে হবে। জিংকসমৃদ্ধ ধান উৎপাদনকারী কৃষককে নগদ, সার জৈব বালাইনাশক বিনামূল্যে দেয়ার মতো প্রণোদনা দিতে হবে। মানুষকে জিংকসমৃদ্ধ চালের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। জিংকসমৃদ্ধ চালের প্রচারে দেশের গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

বাংলাদেশ চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশন

আরও