অভিমত

টেকসই খাদ্যনিরাপত্তায় কৃষি ও ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন জরুরি

আরো চারটি সংস্কার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনগুলো হলো স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

আরো চারটি সংস্কার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনগুলো হলো স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য প্রকাশ করেন।

এর আগে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেগুলো হলো নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ১০টি কমিশন গঠন করা হলেও কৃষি ও ভূমির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো কোনো সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি।

বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারিতে যত মামলা-মোকদ্দমা আছে, তার সিংহভাগ ভূমিকে কেন্দ্র করেই। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বেশির ভাগ বিবাদের মূল কারণ ভূমি। যদিও অনলাইন খারিজ ও অনলাইন ভূমি কর প্রদান ব্যবস্থা এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবু খাসজমি বণ্টন এবং অবৈধ ভূমি দখলের মতো অনেক জটিল সমস্যা রয়ে গেছে। রয়ে গেছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের বিষয়। জেগে ওঠা চরের জমি নিয়ে মারামারি, খুনের ঘটনাও কম ঘটছে না বাংলাদেশে।

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কারের বিষয়টি কঠিন। তবু গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকেই সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতির স্বার্থে সংস্কারকাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। পুরনো অচলায়তন ভেঙে গড়তে হবে মানবিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধ, সবার জন্য সমান অধিকারের বাংলাদেশ। এজন্য কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া কৃষি সংস্কার ও উন্নয়নের মাধ্যমেই শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়েছে।

কৃষি বাংলাদেশের প্রাণ। কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনে কৃষির রয়েছে অনন্য অবদান। কৃষি আমাদের খাদ্য জোগায়। বস্ত্র জোগায়। ওষুধের কাঁচামাল জোগায়। কৃষি থেকে আমরা পাই শিল্পের কাঁচামাল। পাই কৃষিপণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৪০ বিলিয়ন ডলার। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ এখনো কৃষির ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল।

নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের ভূমি, কৃষি ও কৃষক। প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, জমির ওপরের উর্বর অংশ ইট তৈরির কাজে ব্যবহার, নদীভাঙন ও বন্যার ফলে প্রতি বছর কৃষিজমি কমছে শতকরা এক ভাগ হারে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছর পর বাংলাদেশে কোনো চাষযোগ্য জমি পাওয়াটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। সিঙ্গাপুরের মতো খাদ্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। যদি পৃথিবীতে করোনার মতো কোনো মহামারী দেখা দেয় খাদ্যের অভাবে তখন বাংলাদেশকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। লজ্জার বিষয় এক শ্রেণীর অতিলোভী শিল্পপতি ইটিপি ব্যবহার না করে সরাসরি প্রাকৃতিক জলাশয়ে তরল বর্জ্য ফেলছেন। এতে নদী, নালা ও খাল-বিলে মাছের বংশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তরল বর্জ্য দূষণের অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিনষ্ট হচ্ছে। নদ-নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বন্যা বা অতিবৃষ্টির ফলে এসব দূষিত পানি কৃষিজমিতে জমে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা ও উৎপাদিকা শক্তি। অন্যদিকে বালাইনাশক ও রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শাকসবজিতে পাওয়া যাচ্ছে পারদ, সিসা ও ক্যাডমিয়ায়ের মতো ভারী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ সুবিধার অভাব, কৃষিপণ্যের সঠিক বাজার ব্যবস্থা না থাকা, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অপ্রতুলতা এবং বিদেশে কৃষিপণ্য রফতানির বিভিন্ন অসুবিধার কারণে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর লাভবান হচ্ছেন মজুদদার, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।

দেশের কৃষকের সিংহভাগ হলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা নিজেরাই নিজের জমিতে কাজ করেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ফলে তাদের হেক্টরপ্রতি ফলনও হয় বেশি। এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক হলো বাংলাদেশের কৃষির চালিকাশক্তি। অথচ তারা সময়মতো কৃষি ঋণ পান না। বড় বড় কৃষক বিপুল পরিমাণ কৃষি ঋণ উত্তোলন করে কৃষিকাজে ব্যবহার না করে ব্যবহার করছেন অন্য কাজে। এতে কৃষি ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষক ও খেতমজুরদের মধ্যে বণ্টনের আইন থাকলেও এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের নামে খাসজমি লিজ নিয়ে আবাদ না করে ফেলে রাখছেন। আবার অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী দুই-তিন ফসলি কৃষিজমি কিনে কৃষিবহির্ভূত কাজে ব্যবহার করছেন। এতেও ফসলের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। পাবনার ঈশ্বরদীতে দেখেছি পদ্মার নতুন চরের হাজার হেক্টর জমি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গায়ের জোরে দখল করে সেখানে বছরে একবার শুধু খেসারি কলাই বোনে জমি দখল করে রেখেছেন। অথচ সেখানে হাজার হাজার ভূমিহীন কৃষক ও খেতমজুর কৃষিজমির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চরের এসব জমি ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করা গেলে ফসলের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হতো দারিদ্র্য বিমোচন। চীনে বিপ্লবের পর প্রকৃত ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করেও বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে কৃষিপণ্য। সেখানে কৃষকরা আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার করে যেমন একদিকে ফলন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন, অন্যদিকে উৎপাদন খরচও কমাতে পেরেছেন উল্লেখযোগ্যভাবে।

বাংলাদেশ প্রতি বছর পেঁয়াজ, আদা, হলুদ ও রসুন আমদানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে। আমরা একটু উদ্যোগ নিলেই মসলা-ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারি। এরই মধ্যে বস্তায় আদা চাষ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এটাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ ও উৎপাদন এলাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরির মতো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা পেঁয়াজ আমদানি নয়, রফতানিও করতে পারি। নাটোরের লালপুর উপজেলায় কৃষক আমন ধান কাটার পর খেতের অবশিষ্ট নাড়া মাটির সমান করে কেটে সামান্য সেচে ও বিনা চাষে রসুন রোপণ করে প্রচুর লাভবান হচ্ছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রসুন চাষের প্রযুক্তিটি সারা দেশে সম্প্রসারণ করতে পারলে বিদেশ থেকে আর রসুন আমদানি করতে হবে না।

ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করতে না পারার কারণে মামলার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার কৃষক। অথচ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর পরিশোধ না করে বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। তাদের নামে কোনো মামলা হচ্ছে না। তাদের সুদ মওকুফ করে আবার নতুন করে ঋণ দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে এসব অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানানো হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষক দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির শিকার হয়ে মামলার আসামি হয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৫ হাজার ৩৭২ জন কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করেছে ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। গড়ে প্রতি কৃষকের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ২০ থেকে সাড়ে ২৭ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৪ জন কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

শেরেবাংলা একে ফজলুল হক মহাজনদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের হাত থেকে বাংলার দুঃখী কৃষকদের বাঁচানোর জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলে দায়ের করা ১০ লাখ কৃষককে সার্টিফিকেট মামলার অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং কৃষকের সুদসহ সব কৃষি ঋণ মওকুফ করে কৃষি উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ করে কৃষকের যে উপকার করেছিলেন তা কৃষি ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

আমরা মনে করি দরিদ্র ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের সার্টিফিকেট মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা উচিত নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আটকে রাখলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না ব্যাংক অথচ মাত্র ২০ থেকে ২৭ হাজার টাকার জন্য কৃষককে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এটা জাতির জন্য অপমানজনক ও লজ্জার বিষয়। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের স্বার্থে তাদের ঋণ মওকুফ করা উচিত। এটা ছাড়াও দালাল ও ব্যাংকের অসৎ কর্মচারী কৃষকের নামে ভুয়া ঋণ উত্তোলন করে প্রতারিত করছেন সরল প্রকৃতির কৃষকদের। অনেক কৃষক ব্যাংক থেকে কোনো ঋণই গ্রহণ করেননি, তবু তাদের নামে লাল নোটিস পাঠানো হয়েছে। মামলা হয়েছে। এ ধরনের বহু উদাহরণ আছে সারা দেশে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকেও জানা যায়, কেউ মারা গেছেন। কেউ কখনো ব্যাংকে যাননি। অথচ তাদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কৃষি ব্যাংক থেকে ১০ বছর আগে উত্তোলন করা হয়েছে কৃষি ঋণ। কী আজব কাণ্ড! ২০১৪ সালে অনুমোদন করা সেই ঋণ পরিশোধের জন্য ওই ব্যক্তিদের ঠিকানায় ব্যাংকের লাল নোটিস দেয়া হয়েছে। নোটিস পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কেশবপুর শাখায়। স্বাধীনতার আগে মারা যাওয়া চারজনসহ মোট ১৪ জনকে এমন নোটিস দেয়া হয়েছে। তাদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ২০১৪ সালে কৃষি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন পরিমাণ ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১২ জনের বাড়ি উপজেলার স্বণমণি ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে। কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ব্যাংক থেকে কৃষকের নামে ভুয়া ঋণ উত্তোলনকারী এসব দালাল ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাসায়নিক সার কৃষকের মধ্যে সুলভ মূল্যে বিক্রির জন্য প্রতি ইউনিয়নের রয়েছে সরকার নিয়োজিত সারের ডিলার। লক্ষ করে দেখা যায়, এসব ডিলার সার উত্তোলন করে নিজ এলাকার কৃষকদের মধ্যে বিতরণ না করে বেশি দামে অন্য এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। ফলে কৃষককে বাধ্য হয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে রাসায়নিক সার কিনতে হয়। এসব সার ডিলারদের অধিকাংশই প্রকৃত ব্যবসায়ী নয়। ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। এছাড়া বীজ ও বালাইনাশক নিয়ে দেশে চলছে এক তুঘলকি কাণ্ড। এক শ্রেণীর অসৎ বীজ ব্যবসায়ী বাজার থেকে সাধারণ শস্য কিনে প্যাকেটজাত করে মান ঘোষিত বীজ হিসেবে বিক্রি করছেন অহরহ। এতে ফলন কম হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। আবার অনেক বালাইনাশক ব্যবসায়ী নিষিদ্ধ ঘোষিত বালাইনাশক বিক্রি করে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন।

ধান চাষে সেচের ওপর যে ভর্তুকি দেয়া হয় তাতে লাভবান হচ্ছেন সেচযন্ত্রের মালিক। কিন্তু ধান উৎপাদনকারী কৃষকেরা সেই ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই সেচযন্ত্রের মালিককে নয়, ধান উৎপাদনকারী কৃষককে সরাসরি মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে সেচ ভর্তুকি দেয়া উচিত।

সরকার ফসলের ফলন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি বিশেষ করে কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার প্রভৃতির ওপর ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন বড় চাষী ও যন্ত্র বিক্রেতারা। দেশের ৮৫ ভাগ কৃষক হলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তাদের ক্ষুদ্র জমিতে এসব যন্ত্র চালানো যায় না। তাই আমাদের দাবি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জমি উপযোগী ছোট ছোট কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করে সেগুলোর ওপর ভর্তুকি দেয়া হোক।

বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগের ওপর নগরে বসবাস করে। দূরবর্তী গ্রাম থেকে খাদ্যশস্য, ফলমূল, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস এনে তাদের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো হয়। ২০৫০ সালে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। নগরে বসবাসকারী এ বিশাল জনসংখ্যাকে কৃষিকাজের বাইরে রেখে নগরবাসীর খাদ্য, পুষ্টিনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন করা কোনো অবস্থায়ই সম্ভব হবে না। তাই গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগর সরকারের মাধ্যমে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ নগরীয় কৃষির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদেরও সেই পথে অগ্রসর হতে হবে।

কৃষি শ্রমিকের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে কৃষি আজ একটি অলাভজনক পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে মনুষ্যবিহীন কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে প্রচলিত কৃষিকে স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে। স্মার্ট কৃষি হলো জনগণের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর খাবার উৎপাদনকারী, সময় ও মূলধনসাশ্রয়ী একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হাইটেক সিস্টেম। এ সিস্টেম বলতে কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংকস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, অটোমেশন রোবোটিক, ড্রোনের ব্যবহারকে বোঝায়।

দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিরাজমান পাহাড়সমান বৈষম্য হ্রাসে ও টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষি ও ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি।

নিতাই চন্দ্র রায়: কৃষিবিদ ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

আরও