বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফল হিসেবেও পরিচিত। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় কমবেশি এ ফল উৎপাদন হয়। তবে বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, জামালপুর, দিনাজপুর ও পাবনা জেলায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশের মাটি কাঁঠালের উপযোগী। ফলে এর জন্য আলাদা পরিচর্যারও প্রয়োজন পড়ে না। উৎপাদন বেশি হওয়ায় মৌসুমে কাঁঠালের খুব বেশি দাম পান না কৃষকরা। অনেক কাঁঠালই নষ্ট হতে দেখা যায়। ফলে বেশি উৎপাদনের পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে না বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর বহুমুখী ব্যবহার ও ভালো জাতের অভাবে এবং নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি করতে পারছে না বাংলাদেশ।
দেশে বছরে প্রায় ১৯ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৯ হাজার টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৯৩ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৬৯ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৮৭ হাজার টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। কিন্তু এর বিপরীতে রফতানির পরিমাণ খুবই নগণ্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ২১০ টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৯৩২ টন কাঁঠাল রফতানি হয়।
কাঁঠাল উৎপাদনে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৬ সালে বিশ্বের ফল উৎপাদনের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এফএও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তারা বলেছে, অন্যতম পুষ্টিকর ফল কাঁঠালকে মাংসের বিকল্প বলা হয়। সারা বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। পুষ্টিমানের দিক থেকে অন্যতম সেরা এ ফলের চাহিদা বিশ্বব্যাপীই খুব বেশি। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের কাঁঠাল আঠালো হওয়ায় এবং এর মধ্যে বুনো গন্ধ থাকায় এ অঞ্চলের কাঁঠালের চাহিদা কম।
দেশের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে কাঁঠালের জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। মূলত শীতকালীন কাঁঠালে এ ধরনের গন্ধ ও আঠা কম থাকে। তিন-চার বছর আগে খাগড়াছড়ির রামগড়ের চা–বাগানে বারো মাস ফলন দেয়, এমন এক জাতের কাঁঠালের সন্ধান পান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা। গত বছর এ জাতের কাঁঠালের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানীরা। এ জাত থেকে গাছের চারা উৎপাদন ও সম্প্রসারণের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘একটি দেশ একটি অগ্রাধিকার ফল’ শীর্ষক বৈশ্বিক এক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটির জন্য সবচেয়ে উপযোগী ফল হিসেবে কাঁঠালের কথা উল্লেখ রয়েছে।
দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের একটি বড় অংশই নষ্ট হয় সংগ্রহের পর। গবেষকরা জানিয়েছেন, কাঁঠালের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ২৫-৪৫ শতাংশ। কখনো কখনো এ ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটিরও বেশি। কাঁঠাল একই সময়ে পাকতে শুরু করে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই এক-তৃতীয়াংশ কাঁঠাল গাছ থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এসব কাঁঠাল প্রকিয়াজাতের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা গেলে এটা যেমন খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে তেমনিভাবে বিশ্ববাজারেও বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে কাঁঠাল প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
কাঁচা কাঁঠালকে সংরক্ষণ করা গলে এর থেকেই নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করা সম্ভব। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের চেয়েও কম কাঁঠাল উৎপাদন হয়। কিন্তু তারা কাঁচা কাঁঠাল থেকে চিপস, ভেজিটেবল মিট, ফ্রেশ-কাট, ফ্রোজেন, রেডি-টু-কুক, চকোলেট, আচারসহ বহু উৎকৃষ্ট মানের ও মুখরোচক খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করে থাকে। এতে অনায়াসে সারা বছর তারা বাজারে বিক্রি করতে পারে। কাঁচা কাঁঠালের কাটলেট, ভেজিটেবল রোল, শিঙাড়া, সমুচা, পাপড় ইত্যাদি তৈরি করা যায়। ফলে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো কাঁঠাল থেকে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা গেলে তা দেশের বাইরেও রফতানি করা সম্ভব হবে।
আবার কাঁঠালের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা গেলে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা পূরণ করতে পারবে। তবে তার জন্য উত্তম কৃষিচর্যা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশে কাঁঠালের বাণিজ্যিক চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
লেখক: সাংবাদিক