ড. এফএইচ আনসারী বর্তমানে এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেড, এসিআই মোটরস লিমিটেড ও প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে রয়েছেন। কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের চিংড়ি রফতানি নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত বিপ্লব
চিংড়ি রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?
বাংলাদেশ বিশেষ করে বাগদা ও গলদা চিংড়ি রফতানি করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর অনেক বেশি চাহিদা রয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ডলারের চিংড়ি রফতানি হয়। ১০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ডলার রফতানি হতো। গত কয়েক অর্থবছরে চিংড়ি রফতানি কিছুটা কমে গিয়েছিল।
গত অর্থবছরে রফতানি কমে যাওয়ার কারণ কী?
চিংড়ি রফতানি কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে কিছু কারণে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়টা হলো লোকাল অনেক জাত অ্যাভেইলেবল না, অন্যান্য দেশের তুলনায়। আমাদের এখানে প্রতি হেক্টরে চিংড়ির উৎপাদনশীলতা ২৮০-৩০০ কেজি। যেখানে ভারতে প্রতি হেক্টরে ৮০০-৯০০ কেজি, ভিয়েতনামে ৯০০-১০০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হয়। আবার ভেনামি জাতের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ জাতের চিংড়ি অনেক দেরিতে ইন্ট্রোডিউস করা হয়েছে। এটার উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ১০ টনের মতো। ভারত ও ভিয়েতনাম অনেক আগে থেকেই চাষ করছে। কিন্তু আমরা মাত্র শুরু করতে যাচ্ছি। ভেনামি জাতের চিংড়ির চাহিদা বেশি, কারণ এটার দাম কম।
ভেনামি নিয়ে এখন অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ির ভবিষ্যৎ কেমন?
ভেনামি বিদেশে অনেক ভালো করছে। কারণ ভেনামি যারা চাষ করে তারা মোটামুটিভাবে তাদের পুকুর বা ঘের সেভাবে প্রস্তুত করে যেখানে পুকুরের গভীরতা বেশি থাকে। তাছাড়া ভেনামি পোনায় ভাইরাস ইনফেকশন হয় কম, কারণ সেভাবে তাদের চাষাবাদ করা হয়। এ কারণে ভালো পোনা দিয়ে চাষ করতে হবে। আবার ভেনামি চিংড়িকে উন্নতমানের খাবার খাওয়ানো হয় এবং অক্সিজেনের সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়, যার ফলে ভেনামির উন্নতি বেশি হয়। এ কারণে ক্ষেত্রবিশেষে হেক্টরে ১০-১২ টন পর্যন্ত হতে পারে।
বিদেশে কোন ধরনের চিংড়ির চাহিদা বেশি?
বিদেশে ভেনামির চাহিদা অনেক বেশি। আমাদের গলদা বা বাগদা চিংড়িরও প্রচুর চাহিদা আছে। প্রিমিয়াম মার্কেটে অনেক চাহিদা আছে। সমস্যা হলো আমরা প্রাইস ভ্যালু পাই না। কারণ আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী গুণগতমানের চিংড়ি দিতে দিতে পারি না। মাদাগাস্কার থেকে যেটা রফতানি হয় সেটার দাম হলো ১৮-১৯ ডলার। অথচ আমাদের চিংড়ির দাম হলো মাত্র ১০-১১ ডলার। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারি এটা চাষ করেন। ফলে মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
বাগদা ও গলদা চিংড়ির বিদেশে চাহিদা বেশি থাকলেও আমরা কেন সে সুবিধা নিতে পারছি না?
কারণ হলো আমাদের দেশে যেসব জায়গায় চাষ করি সেসব জায়গায় পুকুরের গভীরতা কম। যার কারণে দুপুরে পানি গরম হয়ে যায়। তাই চিংড়িগুলো দৌড়াদোড়ি-ছোটাছুটি করতে থাকে। যার কারণে আমাদের দেশে পোনার মর্টালিটি অনেক হাই। এ কারণে কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদন কম হয়।
চিংড়ি রফতানিতে আমাদের সংকট কোথায়? সংকটগুলো কীভাবে দূর করা যায়?
প্রথমে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। লোকালি চিংড়ি যেখানে চাষ হয় তার কোয়ান্টিটি বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এইচপিএফ পোনা লাগবে। এইচপিএফ পোনা আমাদের খুব বেশি নেই। আমরা যে পোনা চিংড়ি ঘেরে দিই সেগুলোর দৈর্ঘ্য এক সেন্টিমিটার। ৩ সেন্টিমিটারের পোনা দেয়া গেলে ৯০ শতাংশ সারভাইভাল থাকবে। ১০ শতাংশ মর্টালিটি হবে। যে পোনা আমরা ব্যবহার করি তার মর্টালিটি ৭০ শতাংশ। সে কারণে উৎপাদনশীলতা ভালো হচ্ছে না। এছাড়া ঘেরের গভীরতা বাড়াতে হবে। তাহলে দিনের বেলা সূর্যের আলো খুব বেশি গভীরে যাবে না। চিংড়ির খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন দিতে হবে এবং পানির কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে হবে। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রসেসিংয়েরও একটা ব্যাপার আছে। ধরার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে প্রসেসিং করতে হবে। আমাদের ঘেরগুলো থেকে প্রসেসিং ফ্যাক্টরি অনেকটা দূরে। ফলে এসব চিংড়ি যেতে যেতে ১০-১৫ ঘণ্টা লেগে যায়। এর ফলে কোয়ালিটি মেইনটেইন করা হয় না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যে ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রসেস করা হয় সেখানে বরফে ব্যবহৃত পানিটা ভালো না। পানিতে নানা রকম মেটাল থাকে। এ কারণে কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে পারে না। এমনকি পরিবেশও নেই উপযুক্ত। সার্টিফিকেশনেরও একটা সমস্যা আছে। আমাদের দেশের চিংড়ি যখন বাইরে যায় সেখানে একটা ধারণা আছে যে চিংড়ির মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। কিন্তু কথা হলো খাবার জিনিসের মধ্যে মন্দের কোনো সুযোগ নেই। সেটা ভালোই হতে হবে। চিংড়ি নিয়ে আমরা কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে ভেনামি নিয়ে কথা বলতে হবে। ভিয়েতনাম এখানে অনেক ভালো করছে। আমরা ততটা করতে পারছি না।
আমাদের দেশে জেলি মেশানোর কারণে রফতানিতে সমস্যা হচ্ছে। এটা থেকে বের হওয়ার জন্য কী করা যায়?
চিংড়ি নিয়ে আমাদের শক্তিশালী অ্যাসোসিয়েশন আছে এবং তারা টাইম টু টাইম তদন্ত করে। তারা এখন দেখার চেষ্টা করছে কোনো ফ্যাক্টরি কাজটা করছে কিনা। সরকারও দেখার চেষ্টা করছে। তার পরও অনেকেই এটা করছে। এটা রোধ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ জেলি দেয়া চিংড়ির বিষয়টা রোধ না করলে চিংডির ভবিষ্যৎ খুব খারাপ। একটা উদাহরণ দিই, আমাদের দেশে চিংড়ি চাষ হলেও বিরাট আকারে খামার নেই, বরং অনেক ছোট খামারি আছেন। এর মাঝে পাইকার যারা আছেন তারা খামারিদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনে কোম্পানিকে সাপ্লাই দিয়ে থাকেন। আসলে কোন খামারি কী করলেন সেটা কোম্পানিগুলোর বের করাটা খুব কঠিন।
মৎস্য রফতানিতে আমাদের দেশের মোট বাজার কেমন?
আমরা মৎস্য রফতানিতে ভালো করতে পারি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভালো করছি না। তার পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। যেসব মাছ আমরা রফতানি করি—রুই-কাতলা—এগুলো আমরা যে বাজারে রফতানি করছি সেটা খব একটা বড় না। আমরা যদি ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য রফতানি করতে পারি তাহলে লাভ বেশি, আবার চাহিদাও বেশি। যেমন আমাদের তেলাপিয়া এবং পাঙাশ এই দুই মাছের চাহিদা অনেক গ্লোবালি। এই মাছকে যদি আমরা ফিলার হিসেবে বিক্রি করতে পারি তাহলে ভালো হবে। সমস্যা হচ্ছে তেলাপিয়া আমাদের দেশে যেভাবে চাষ হয় দেখা যায় মাটি খায়, যার কারণে নানা সমস্যা হয়। তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের দেশের তেলাপিয়া মাছের মিটের কালার ইয়েলো হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে মাছের ইয়েলো মিটের চাহিদা কম, বরং হোয়াইট মিটের চাহিদা বেশি। তারপর আমরা যেখানে তেলাপিয়া ও পাঙাশ চাষ করি সেখানকার ফিড কনভারশন রেশিও অনেক বেশি। আমাদের দেশে ১ দশমিক ৪ বা ৫ কিলোর নিচে এক কেজির তেলাপিয়া ধরতে পারে না। অথচ থাইল্যান্ডে কিন্তু কম। তাই ওখানে কস্ট অব প্রডাকশন অনেক বেশি। তাহলে বলা যায় ইয়েলো মিট এবং কস্ট অব প্রডাকশন অনেক বেশি। এসব কারণেই আমাদের দেশের মাছের মার্কেট খুব একটা বড় না। আমরা যদি ভাবি যে তেলাপিয়া মাছ রফতানি করব, তাহলে কিন্তু চাহিদাও খুব একটা বেশি না আর লাভও বেশি হবে না। তাই মাছ রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হবে কোন জাতের মাছ রফতানি করা যায়। এছাড়া মাছের কোয়ালিটি ভালো করতে হবে।