২০২১ সালে দেশে প্রথম ভেনামি চিংড়ি আবাদ শুরু করে যশোরের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এমইউসি ফুডস। খুনার পাইকগাছা নোনা পানি কেন্দ্রের (বিএফআরআই) ১০ একর জমিতে ভেনামি চিংড়ি আবাদ করেন তারা। হেক্টরপ্রতি মাছ উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার কেজি। প্রথাগত চিংড়ি চাষে যেখানে হেক্টরপ্রতি মাছ পাওয়া যেত ৪০০ কেজি, সেখানে ভেনামি চাষে ১০ গুণেরও বেশি ফলন পেয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিংড়ির বৈশ্বিক বাজার ৩২ বিলিয়ন ডলার। যার ৮২ শতাংশ দখল করে রয়েছে ভেনামি চিংড়ি। সাদা চিংড়ি ৭-৮ শতাংশ, গলদা ২-৩ শতাংশ এবং সাগর থেকে আহরিত হয়ে থাকে বাকিটা। দেশে ২ লাখ ৬ হাজার ৭৬৩ হেক্টর জমিতে চিংড়ির আবাদ হয়ে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭২ হাজার ৮০৯ টন চিংড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ভেনামি চিংড়ি রয়েছে ৮০ শতাংশ। সরকারও এখন ভেনামি চিংড়ি চাষে ব্যাংকঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আশা করা হচ্ছে খাদ্যপণ্যটির উৎপাদন বাড়বে।
যশোরের বিসিক শিল্পনগরীতে এমইউসি ফুডসের যাত্রা শুরু করা হয় ১৯৮৫ সালে। ৩০ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর। বর্তমানে প্রতিদিন ৩৩ দশমিক ৫ টন উৎপাদন করা হচ্ছে হিমায়িত চিংড়ি। বর্তমানে ১৯টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে এ চিংড়ি। প্রতিষ্ঠনাটিতে কর্মরত রয়েছেন স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ৩৫০ কর্মী। যার ৬০ শতাংশই নারী। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ১ কোটি ২৭ লাখ, ২০২০ সালে ৯৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০২১ সালে ১ কোটি ৫ লাখ এবং ২০২২ সালে ৮৮ লাখ ২০ হাজার ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করেছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তিনবার সিআইপি মনোনীত হয়েছেন।
এমইউসি ফুডসের ব্যবস্থাপক সুব্রত সরকার জানান, সম্ভাবনাময় হিমায়িত চিংড়ি শিল্প হুমকির মুখে। কাঁচামালের অভাব, বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা কারণ চিংড়ি চাষীদের নিরুৎসাহিত করছে। তার পরও আমরা সাফল্যের সঙ্গে হিমায়িত চিংড়ি রফতারি করছি। পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করি শতাধিক চাষীর কাছ থেকে। প্রথমে প্রান্তিক চাষীদের অগ্রিম টাকা দেয়া হয়। মাছ সংগ্রহের পর নিজস্ব ফ্রিজার ভ্যানে করে যশোরে আনা হয়। এরপর আধুনিক মেশিনের সাহায্যে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী কখনো মাথা ও খোসাসহ আবার কখনো মাথা-খোসা ছাড়া প্যাকেটজাত করা হয়। এরপর গ্রাহকদের ব্র্যান্ড অনুযায়ী মোড়কজাত করে রফতানি করে থাকি। আমেরিকা, ইউরোপ, জাপানসহ ১৯টি দেশে রফতানি হয়ে থাকে এমইউসি ফুডসের চিংড়ি।
প্রতিষ্ঠানটির নারী কর্মী রোজিনা পারভিন জানান, ইউরোপ, জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে আনা মেশিনে আমরা প্রক্রিয়াজাত করে থাকি। এরপর সঠিক মানদণ্ড মেনে রফতানির জন্য প্যাকেটজাত হয়ে থাকে। আরেক কর্মী তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করে আমরা ভালো আছি। করোনাকালে রফতানি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও বেতন বন্ধ হয়নি। যে কারণে আমরা সবাই সঠিক নিয়ম মেনে কাজ করি।’
এমইউসি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, সঠিক তাপমাত্রা মেনে আমরা ফ্রিজার ভ্যানে করে মোংলা দিয়ে বিদেশে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করছি। পুরনো পদ্ধতিতে চাষ করার কারণে চিংড়ির উৎপাদন কম হতো। ২০২১ সালে আমরাই প্রথম দেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন শুরু করি। চলতি বছর সরকার ভেনামি চিংড়ি আবাদের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যটির উৎপাদন বেড়ে যাবে। প্রথগত পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি যে মাছ প্রায় ৪০০ কেজি পাওয়া যায়, সেখানে ভেনামি চিংড়ি ১০ হাজার কেজি উৎপাদন সম্ভব। দেশের ১০ লাখ মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ খাতে আরো বিনিয়োগ বাড়বে। তখন সৃষ্টি হবে মানুষের কর্মসংস্থান। যদিও সরকার আগস্টে ভেনামি চিংড়ি আবাদে ব্যাংকঋণের ঘোষণা দিয়েছে। আশা করছি এতে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন। কেননা আগে এ খাতে কোনো ঋণ পাওয়া যেত না।
তিনি বলেন, ‘বিদেশে আগে হোটেলে ফুডস সার্ভিসে বিক্রি হতো চিংড়ি। রিটেইলে হতো না। কিন্তু এখন ভেনামি আবাদ হওয়ায় রিটেইলের অংশ বেড়ে যাবে।’
চিংড়ি চাষীরা বলছেন, দেশীয় বাগদা-গলদার হ্যাচারিতে মাদার চিংড়ি এনে পোনা উৎপাদন সম্ভব। প্রতি পিস পোনা আমদানিতে খরচ পড়ছে ৩-৪ টাকা। তবে নিজস্ব হ্যাচারিতে মাদার চিংড়ি এনে পোনা উৎপাদনে খরচ হবে মাত্র ১-২ টাকা। যেহেতু সরকার বাণিজ্যিক অনুমতি দিয়েছে। সে কারণে আগামীতে স্বল্পমূল্যে ভোক্তা পর্যায়ে চিংড়ি বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
চিংড়ি উৎপাদনকারীদের দেয়া তথ্যমতে, এশিয়ার ১৪টি দেশে ভেনামি চিংড়ির ব্যাপক চাষ করা হচ্ছে। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন বাগদার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ২০২০ সালে চিংড়ির বিশ্ববাজার ছিল ১৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা ২০২৬ সালে দাঁড়াবে প্রায় ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের। যার বৃহৎ অংশ ভেনামির দখলে। বিগত দুই দশক ধরে বিশ্বের ৬২টি দেশ ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে। বিশ্বে সর্বমোট চিংড়ি উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ ভেনামি চিংড়ি।
এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতীত ১৪টি দেশেই বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করে থাকে। ভেনামির সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজলভ্য হওয়ায় তা বিশ্বের ৭৭ ভাগ বাজার দখল করে নিয়েছে। ভেনামির উৎপাদন বেশি এবং আকার প্রায় একই হয়। ফলে ভেনামি চিংড়ি ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদামতো দেয়া যায়, যা গলদা-বাগদার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ বাংলাদেশে প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা ব্যাপক। এখন গলদা ও বাগদার পাশাপাশি যদি ভেনামিকে আমরা রেগুলার এক্সপোর্ট বাস্কেট নিতে পারি তাহলে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে পপুলার চিংড়ির অর্ডারের দেশ হিসেবে পরিণত হব।’
শ্যামল দাস বলেন, ‘গত বছর প্রতি হেক্টর পুকুরে ৮ হাজার ৯০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। এ বছর উৎপাদন সাড়ে ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার কেজিতে নিয়ে যাব। পাইকগাছায় পাঁচটি পুকুরে আশা করছি ২৫ টন ফলন পাব। আর বটিয়াঘাটা থেকে আরো ৩০-৩৫ টন ফলন পাব।’
বটিয়াঘাটার মাছচাষী প্রফুল্ল কুমার রায় বলেন, ‘এমইউসি ফুডসের শ্যামল দাসের সহযোগিতায় সরকারি এরিয়ার বাইরে প্রথম বটিয়াঘাটার ১২টি পুকুরে ভেনামি চিংড়ি চাষ হচ্ছে। সেখানে ৫০ লাখ পোনা ছাড়া হয়েছে। প্রথম মাছটি ৩০ দিনে সাড়ে ৪ গ্রাম গড়ে ওজন পেয়েছি। পরেরটাতে ওজন পৌনে ৫ গ্রাম পেয়েছি। এ সময়ে বাগদা ২ থেকে আড়াই গ্রাম পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘বাগদার দাম ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। আমি ধারণা করছি এই চিংড়ি উৎপাদন খরচ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পড়বে। উৎপাদন বাড়লে অন্যান্য দেশের মতো ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হবে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ এ চিংড়ি খেতে পারবে।’
প্রফুল্ল কুমার রায় বলেন, ‘সরকার ভেনামি চাষের অনুমতি দেয়ার ফলে দেশের অর্থনীতি মজবুত হবে। আমাদের চাহিদা পূরণ হবে, বিশ্ববাজারে এটা রফতানি বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি পাওয়ার পর মাদার চিংড়ি এনে পোনা তৈরি করতে পারলে সুবিধা হবে। এখন প্রতি পিস পোনা আমদানি করতে ৩-৪ টাকা খরচ পড়ছে। অথচ মাদার চিংড়ি এনে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করলে পোনার দাম পড়বে ১-২ টাকা। ফলে চাষীরা লাভবান হবেন, কমবে চিংড়ির দামও।’
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সারা বিশ্বে ভেনামি চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ চিংড়ির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। যে কারণে সহজেই এটির বাণিজ্যিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এটিকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বিদেশী পোনা আমদানি করে চাষীদের দিলে খরচ বেশি পড়ে। এজন্য আমাদের হ্যাচারিতে এ পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। খাবারটাও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে হবে। বায়ার সিকিউরিটি মেইনটেইন করতে হবে। এর খাবার, অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহারের কিছুটা প্রভাব কিন্তু থাকবে। কিছু রোগ-বালাই হবে। সেগুলো যাতে অন্য মাছের ও পানির ক্ষতি না করে খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো করতে পারলে আমরা আগামী দু-এক বছরেই ফিল্ড লেভেলে যেতে পারব।’
যশোর জেলা মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক মাহবুবুর রহমান জানান, সরকার ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। আমাদের বিসিকে অবস্থিত এমইউসি ফুডস ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে। তারা বেশ সাফল্যর সঙ্গে বিদেশে রফতানি করে চলেছে।
লেখক: সাংবাদিক