আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ও বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে গত ৬ এপ্রিল ‘আনলিশিং দ্য পটেনশিয়াল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স মার্কেট—প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক একটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে এ ক্রোড়পত্র।
পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে কৃষি বীমাকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে
মুজিবুল হাসান সেজান
(কান্ট্রি ডিরেক্টর, সুইসকন্ট্যাক্ট-বাংলাদেশ)
‘আনলিশিং দ্য পটেনশিয়াল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স মার্কেট—প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক আজকের আয়োজনে বাংলাদেশের কৃষি বীমার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার আশা করছি। পাশাপাশি বীমা খাতকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে। ক্ষুদ্র বীমা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অনেকগুলো ধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শুধু তা-ই নয়, এটি বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ২০৪১-এর সঙ্গেও সম্পর্কিত। তথাপি বাংলাদেশের বীমা খাতের বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ খাতের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। আমাদের লক্ষ্য হলো বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে কৃষি বীমাকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে খাতটি তার সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশের কৃষকদের সহায়তা করতে সুইজারল্যান্ড সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ
সৈয়দা জিনিয়া রশিদ, পিএইচডি
সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড দূতাবাস
বাংলাদেশের কৃষি খাত উন্নয়নে সুইজারল্যান্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা দিন দিন আরো বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের কৃষি খাত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এটি মোকাবেলায় ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বিএমএমডিপি প্রকল্পটি প্রণয়ন করে। উদ্দেশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের কৃষকদের বীমাসেবার আওতায় আনা। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে আমরা বদ্ধপরিকর। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে বিএমএমডিপি প্রকল্পটি এরই মধ্যে তার লক্ষ্যের চেয়েও বেশি সাফল্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে। পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা ৩ লাখ ৩৬ হাজার কৃষকের কাছে পৌঁছতে পেরেছি, যারা গবাদিপশু পালন করেন। আশা করছি, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ প্রাপ্ত ফলাফল প্রকল্পের নির্ধারিত লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে কৃষি বীমা সম্প্রসারণে সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সহযোগীদের যৌথ পার্টনারশিপ গুরুত্বপূর্ণ
টিম গামপার
আন্তর্জাতিক বীমা বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা প্রধান
আলোচ্য গবেষণাটি আমরা চারটি বিষয় সামনে রেখে পরিচালনা করেছি। এক. বাংলাদেশের ক্ষুদ্র বীমার বাজার ব্যবস্থা; দুই. সংশ্লিষ্ট বাজার প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ; তিন. ক্ষুদ্র বীমার সম্ভাবনাময় উপখাত নিয়ে বিশ্লেষণ এবং চার. ক্ষুদ্র বীমা খাতের পরিকল্পনার প্রস্তাব। এতে তিনজন স্থানীয় ও তিনজন ক্ষুদ্র বীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কাজ করেছেন। তারা বীমা খাত উন্নয়নে ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে আমি সবাইকে যে বার্তাটি দিতে চাইছি তা হলো, বাংলাদেশে কৃষি বীমার সম্প্রসারণ সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সহযোগীদের যৌথ পার্টনারশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র বীমাকে সফল করতে হলে এর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র বীমার আওতাভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বীমা বাজারের ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা অর্থনীতিকে ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রিমিয়াম দেবে।
ক্ষুদ্র বীমা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর উন্নয়ন ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন
ডেনিস জেরান্ড
আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র বীমা বিশেষজ্ঞ
ক্ষুদ্র বীমা দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মানুষের ঝুঁকি প্রশমনে সাহায্য করে। তাই ক্ষুদ্র বীমার প্রিমিয়ামের পরিমাণ গ্রাহকের ১০ দিনের আয়ের বেশি নির্ধারণ করা উচিত নয়। বাংলাদেশ সরকার তার অগ্রাধিকারমূলক পরিকল্পনা—যেমন বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র বীমায় গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে জনপ্রতি মাথাপিছু বীমা খরচ মাত্র ৮ ডলার, অথচ ভারতে এটি ৭১ ডলার। সুতরাং বাংলাদেশে বীমা খাতের উন্নয়নে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফিলিপাইন যেমন মাত্র ২০ বছরে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশকে বীমার আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে দারুণ অগ্রগতি দেখিয়েছে। ক্ষুদ্র বীমাবাজারের উন্নয়নে বাংলাদেশ ফিলিপাইনের প্রক্রিয়াগুলোকে অনুসরণ করতে পারে। গবাদি পশুসম্পদের ক্ষেত্রে ৭৪ মিলিয়ন ডলার হলেও বাংলাদেশে শস্য বীমার সম্ভাবনা ৫৪৯ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে প্রায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মালিক নারী। এ পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র বীমার বাজার বিদ্যমান। তবে এ বাজার থেকে সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশে বীমা কোম্পানির পণ্য সরবরাহ দিকের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে সীমিত বাজার তথ্য, দুর্বল পণ্য উন্নয়ন, স্বল্প প্রযুক্তি, দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থা, অ্যাকচুয়ারি-সংক্রান্ত দক্ষতার পাশাপাশি বাণিজ্যিক কার্যকারিতা-সংক্রান্ত উদ্বেগ। চাহিদা দিকের চ্যালেঞ্জগুলো হলো আস্থার অভাব, প্রিমিয়াম প্রদানে আর্থিক সামর্থ্যের অভাব এবং বীমা দাবি পরিশোধে কালক্ষেপণ। চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণের জন্য অ্যাকচুয়ারিয়াল দক্ষতার উন্নয়ন, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন অংশীদারত্ব ও উদীয়মান ক্ষেত্রসহ একটি ক্ষুদ্র বীমা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর উন্নয়ন ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন।
বীমা শিল্পে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গাইডলাইন বা রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে
ইলিয়াস ওমানডি
আন্তর্জাতিক কৃষি বীমা পলিসি বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশের কৃষিবাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো বীমার আওতায় আসেনি, যা খাতটিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রধান ফসল উৎপাদনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জাতীয় ফসল উৎপাদনের গড় ৬ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। তাই আমাদের উচিত বীমা পরিকল্প উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া। প্রথমে ক্রেতাদের সংখ্যা বিবেচনায় রেখে পণ্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে বীমাপ্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বণ্টন ব্যবস্থা—এদিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি। বাংলাদেশের কৃষকেরা যেহেতু পিরামিডের সবচেয়ে নিচের দিকে অবস্থান করেন, তাই তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের অবশ্যই বিকল্প সরবরাহ চ্যানেল নিশ্চিত করতে হবে। এখানে ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা এটি গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন পথ উন্মোচন করে। তবে আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে কৃষকেরাও এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে কৃষি বীমা ক্রয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। অন্যথায় প্রডাক্ট পরিকল্পনা করাটা হবে অমূলক। কৃষি বীমার ক্ষেত্রে আমাদের ট্যাক্স ও ভ্যাট কমাতে হবে। পাশাপাশি আমাদের একটি নির্দেশিকা বা রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যা স্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেবে শিল্প হিসেবে আমাদের গন্তব্য কোথায় বা আমরা কোন জায়গায় পৌঁছতে চাই।
বীমার স্বল্প প্রিমিয়াম নির্ধারণ এবং একে ভ্যাটমুক্ত করতে হবে
সৈয়দ শাহিরয়ার আহ্সান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাধারণ বীমা করপোরেশন
বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৮৭ লাখ পরিবার রয়েছে, যার মধ্যে ১ কোটি ৫২ লাখ পরিবারই কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আমরা সাধারণ বীমা ঘিরে অনেক কাজ করেছি, কিন্তু কৃষি বীমা এখনো অবহেলিতই রয়ে গেছে। আমরা যদি কৃষকদের বীমাসেবার আওতায় আনতে পারি, তাহলে কৃষি খাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সাধারণ বীমা করপোরেশন ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম শস্য বীমার প্রচলন করে। এখানেই সাধারণ বীমা করপোরেশন থেমে থাকেনি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগও তারা নিয়েছে। ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহায়তায় সাধারণ বীমা করপোরেশন তিনটি জেলায় বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় সফলভাবে বীমা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে সাধারণ বীমা করপোরেশন, সুইসকন্ট্যাক্ট ও সিনজেনটা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় উত্তরাঞ্চলে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা চালু করেছে। তবে আমাদের অবশ্যই বীমা প্রিমিয়াম কম এবং একে ভ্যাট-ট্যাক্সমুক্ত রাখতে হবে। এ খাতে সরকারের ভর্তুকি বীমার প্রিমিয়াম কমাতে পারে, যা সবার জন্য সাশ্রয়ী সেবা নিশ্চিতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সঙ্গে বীমার প্রিমিয়াম প্রদানের সুবিধা দিতে পারে। বীমা দাবি নিষ্পত্তির সময়সীমাও ১৫ দিনে কমিয়ে আনতে হবে।
কৃষি বীমা বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতার ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ
মো. বেনজীর আলম
মহাপরিচালক, কৃষি অধিদপ্তর
কৃষক মাঝে মাঝে পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। অনেক সময় কৃষক পণ্য বিক্রি করে ফসল উৎপাদন খরচও উঠাতে পারেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ, পোকামাকড়ের আক্রমণে মাঝেমধ্যেই ফলন বিপর্যয় দেখা দেয়। দুর্যোগে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারগুলো আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষকদের এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার কৃষি ও কৃষক পুনর্বাসনে নানা কার্যক্রম হাতে নিলেও তা যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে কৃষির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যাপকভাবে শস্য বীমা বা কৃষি বীমা চালু করা জরুরি। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কৃষকদের জন্য কৃষি বীমা চালুর কথা জানান। কৃষিপণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে কৃষক সাময়িক সরকারি সহায়তা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব খুব কমই থাকে। এরই মধ্যে আমরা জানতে পেরেছি যে দেশের কিছু কিছু এলাকায় পাইলটভিত্তিক কৃষি বীমা চালু করা হয়েছে। কৃষি বীমা বাস্তবায়নে জনসচেতনতার অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতার ঘাটতি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। কৃষি বীমা চালু করা হলে তা ফসল উৎপাদনে যুক্ত হয়ে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া বীমার প্রিমিয়াম কৃষকের কাছে বাড়তি বোঝা মনে হতে পারে। পাশাপাশি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে শস্য বীমা চালু করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
কৃষকের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বীমা স্কিম প্রণয়ন করতে হবে
বিএম ইউসুফ আলী
সভাপতি, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম
প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির কারণে ১০-২০ শতাংশ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়, যা কৃষকদের মানসম্পন্ন বীজ-সার ক্রয় ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অনুৎসাহিত করে তোলে। এক্ষেত্রে কৃষকরা বীমার মাধ্যমে সহায়তা লাভ করলে তারা আরো বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, যার মাধ্যমে দেশও উপকৃত হবে। এটি আমাদের কৃষি খাতকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে কৃষকের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনাপূর্বক বীমা পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এটি অবশ্যই কৃষকের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কম প্রিমিয়ামে উচ্চ সুবিধাসমৃদ্ধ স্কিম হতে হবে।
বীমা দাবি ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করতে হবে
কোরিন হেনচোজ পিগনানি
ডেপুটি হেড অব কো-অপারেশন, বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড দূতাবাস
ক্ষুদ্র বীমা বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে কার্যকর একটি উপাদান হতে পারে। সর্বোপরি এটি বাংলাদেশের কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা জোগাবে। আমি লক্ষ করেছি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে ক্ষুদ্র বীমা কীভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের চাহিদার নিরিখে ক্ষুদ্র বীমা স্কিমকে সতর্কতার সঙ্গে প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বীমা দাবি ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করতে হবে।
কৃষি বীমা উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে
শেখ কবির হোসেন
সভাপতি, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অতীতে বাংলাদেশের মানুষের আয়ের প্রধান উৎসও ছিল কৃষি। তবে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবহেলার কারণে খাতটি এখন পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের এখন কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কৃষকদের কাজে লাগে এমন বীমা পণ্য প্রণয়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয়কেই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি কৃষি বীমার ভ্যাট ও কর ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হবে। কৃষি বীমা স্কিমে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষি বীমা জনপ্রিয় করতে প্রিমিয়ামে ভর্তুকি ও কর রেয়াতের মতো সুবিধা দিতে হবে
ড. এম মোশাররফ হোসেন, এফসিএ
চেয়ারম্যান, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট বিপদ থেকে দেশের কৃষকদের বাঁচাতে বীমা কোম্পানি হিসেবে আমাদের মানসম্পন্ন বীমা পলিসি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রডাক্ট ও সেবাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে গ্রাহকরা সেটি গ্রহণে উৎসাহিত হয়। সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ, শূন্য সুদহার, বিস্তৃত ঋণের কাভারেজ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ প্রডাক্টগুলো কৃষি বীমার বিস্তৃতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কৃষি বীমা জনপ্রিয় করতে প্রিমিয়ামে ভর্তুকি ও কর রেয়াতের মতো সুবিধা দিতে হবে।
ক্ষুদ্র বীমার পাশাপাশি কৃষি বীমার জন্য সুনির্দিষ্ট পলিসি গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে
শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ
সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু তা-ই নয়, আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমরা সচেষ্ট। সরকারের বিচক্ষণ নীতির সঙ্গে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আমি সব বীমা কোম্পানিকে বীমা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আধুনিকায়নের অনুরোধ করব। এটি শুধু তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল করার জন্যও প্রয়োজন। দেশে ক্ষুদ্র বীমার পাশাপাশি কৃষি বীমার জন্যও সুনির্দিষ্ট পলিসি গাইডলাইন থাকা উচিত। একই সঙ্গে আমি এ খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে প্রয়োজনীয় নীতি কাঠামো তৈরিতে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আইডিআরএতে আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করছি। উপরন্তু বীমা কোম্পানিগুলো বিদ্যমান বাজারের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায়ও তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করার সুপারিশ করছি। আমি কৃষি মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ ও মত্স্য মন্ত্রণালয়কে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মত্স্য খাতে ক্ষুদ্র বীমা প্রসারে উদ্যোগ নেয়ারও সুপারিশ করছি।
২০৪১ সালের মধ্যে বীমার বাজার ব্যাপ্তি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে
আবদুল্যাহ হারুন পাশা
অতিরিক্ত সচিব
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়
আজ আমরা একটি সফল ওয়ার্কশপ শেষ করতে পারায় আলোচক ও অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের কৃষি খাতকে বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে রক্ষায় ক্ষুদ্র বীমা কীভাবে কাজ করতে পারে তার কৌশল নির্ধারণে সহায়তা জোগানো। এ কাজে সহযোগিতার জন্য আমি সুইজারল্যান্ড সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আশা করি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব। এ কথা সত্য, বাংলাদেশে বীমা খাতের বাজার ব্যাপ্তি (মার্কেট পেনিট্রেশন) এখনো অনেক কম। আমি বিশ্বাস করি, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এটিও ধীরে ধীরে বাড়বে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বীমার বাজার ব্যাপ্তি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে।