দেশের একমাত্র নরম কাঁকড়া উৎপাদন ও রফতানি করছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও কাঁকড়া রফতানিতে এক অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। বাগদা বা গলদা চিংড়ির পরই অবস্থান কাঁকড়ার। এরই মধ্যে সাতক্ষীরার উৎপাদিত কাঁকড়া ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। রফতানি চাহিদাও বাড়ছে প্রতি বছর এসব দেশে।
অন্যদিকে এ কাঁকড়া শিল্পকে ঘিরে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনমান। এর মাধ্যমে সরাসরি জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে অন্তত ২০ হাজার মানুষের।
তবে খামারিদের দাবি, সময়মতো কাঁকড়ার রেণু পোনা সরবরাহ নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রফতানি আয়ে চিংড়িকে ছাড়িয়ে যাবে কাঁকড়া। কেননা চিংড়ির মতো ঝুঁকি নেই কাঁকড়া উৎপাদনে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, দেশের একমাত্র রফতানিজাত নরম কাঁকড়া উৎপাদন হয় সাতক্ষীরায়। এ জেলায় ৩৬৪টি খামারে এ নরম কাঁকড়া উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে শুধু শ্যামনগর উপজেলায়ই ৩৫০টি খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে দিনরাতে পরিচর্যা করে উৎপাদন হচ্ছে নরম কাঁকড়া। সূত্রটি আরো জানায়, সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ ও রফতানি হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে। বছরে প্রায় তিন হাজার টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়ে থাকে জেলায়। এর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাতক্ষীরা থেকে নরম কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ৫৬৭ টন, যার মূল্য ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার ডলার। ২০২০-২১-এ রফতানি হয়েছে ৫১৮ টন, রফতানি মূল্য ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ডলার, ২০২১-২২-এ রফতানি হয় ৮০২ টন, যার রফতানি মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৬২২ টন, যার রফতানি মূল্য ৮৬ লাখ ৯৮৮ ডলার।
শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কলবাড়ী গ্রামের রফতানিজাত কাঁকড়া উৎপাদনকারী খামার ভাই ভাই এগ্রো ক্র্যাব ফিশারিজের স্বত্বাধিকারী বিশ্বনাথ মণ্ডল জানান, তিনি এক দশক ধরে কাঁকড়া উৎপাদন করেন। ১৬ বিঘা জমির ওপর খামারে নরম কাঁকড়া উৎপাদন করে আসছেন ২০১৭ সাল থেকে। ৫৫ হাজার ভাসমান প্লাস্টিকের খাঁচায় এসব কাঁকড়া উৎপাদন করেন তিনি। ১০০ গ্রাম ওজনের একেকটি কাঁকড়া স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে খাঁচায় ১৮ থেকে ২০ দিন ধরে মোটাতাজা করা হয়। এ সময় কাঁকড়াকে খাদ্য হিসেবে ছোট তেলাপিয়া মাছ খাওয়ানো হয়ে থাকে। এরপর কাঁকড়া খোলস
পাল্টানোর পর একেকটি ১৫০ গ্রাম পরিমাণ ওজন হলে ওই নরম কাঁকড়া
এরপর » পৃষ্ঠা ২১
পার্শ্ববর্তী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ফরিদ নাইন স্টার এগ্রো বিডি লিমিটেডের কাছে বিক্রি করেন। ২৫ জন শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণকাজে নিয়োজিত রয়েছেন বলে জানান তিনি।
একই এলাকার রোহন এগ্রো ক্র্যাব ফিশারিজের স্বত্বাধিকারী রাজিব জোয়াদ্দার বলেন, ‘সুন্দরবন ও নদীর ওপর নির্ভর করে জীবিকা অর্জন করতে হয় উপকূলীয় এলাকার মানুষের। বারো মাসই বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। তবে আশার বিষয় হলো, প্রাকৃতিকভাবে সংগ্রহ করা কাঁকড়া রফতানি করার কারণে এ এলাকার মানুষের জীবনমান বদলে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি মাসে ৯-১০ হাজার কেজি কাঁকড়া উৎপাদন করেন। তবে কাঁকড়া খামারি বিশ্বনাথ মণ্ডল ও রাজিব জোয়াদ্দার বলেন, ‘খুবই সম্ভাবনাময় হলেও সমস্যা হচ্ছে যখন মূল উৎপাদন মৌসুম তখন থাকে সরকারের পক্ষ থেকে কাঁকড়া আহরণে নিষেধাজ্ঞা।’ এ সময়টা বিবেচনা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।
নরম কাঁকড়া রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান উপকূলীয় শ্যামনগর দাতনেখালী এলাকার ফরিদ নাইন স্টার এগ্রো বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আমির হোসেন জানান, ২০১৫ সাল থেকে নরম কাঁকড়া রফতানি করে আসছে তার প্রতিষ্ঠান। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে শ্যামনগরের নরম কাঁকড়া। বছরে ৩০০ থেকে ৩৫০ টন কাঁকড়া রফতানি করে তার প্রতিষ্ঠান। তবে করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রফতানি কিছুটা কমে গেছে। তিনি জানান, সাতক্ষীরার নরম কাঁকড়া রফতানিতে খুবই সম্ভাবনাময়। ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে খামারিদের কাঁকড়া রেণু পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে কাঁকড়া রফতানি।
দাতনেখালী এলাকার আরো এক কাঁকড়া রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান একোয়া ম্যাক্সের ব্যবস্থাপক মোহাম্মাদ হাসান জানান, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কাঁকড়া রফতানি করছে তার প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে জাপান, মালয়েশিয়া, চীন ও থাইল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। বছরে ২০০ টনের মতো কাঁকড়া রফতানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া এখানে জাপান ফার্স্ট ট্রেড লিমিডেট নামে আরো একটি কাঁকড়া রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানিতে চিংড়ির পরই অবস্থান কাঁকড়ার। ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অনেক দেশে খুবই চাহিদা রয়েছে নরম কাঁকড়ার। তবে নরম কাঁকড়া দেশে একমাত্র উৎপাদন হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলায়। বিশেষ করে উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলায়ই ৯০ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে। এতে উপকূলীয় এলাকার বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দিন দিন এর প্রসার ঘটছে। চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়া উৎপাদনে ঝুঁকি কম। উৎপাদন খরচও বেশি লাগে না। কম জায়গায় বেশি উৎপাদন করা যায়।’
লেখক: সাংবাদিক