ঐতিহ্য ধরে রেখে কুষ্টিয়ার মিঠা পাতার পান যাচ্ছে বিদেশে

পান চাষে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা কুষ্টিয়ার খ্যাতি অনেক পুরনো। পান চাষের আওতা খুব বড় না হলেও বহু আগে থেকেই জেলায় পানের আবাদ হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুষ্টিয়ার এ পান বেশ জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। কুষ্টিয়ার পানকে বলা হয় ‘মিঠা পাতার’ পান। এই মিঠা পাতার পানের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে। আয় করে আনছে ফরেন কারেন্সি।

পান চাষে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা কুষ্টিয়ার খ্যাতি অনেক পুরনো। পান চাষের আওতা খুব বড় না হলেও বহু আগে থেকেই জেলায় পানের আবাদ হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুষ্টিয়ার এ পান বেশ জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। কুষ্টিয়ার পানকে বলা হয় ‘মিঠা পাতার’ পান। এই মিঠা পাতার পানের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে। আয় করে আনছে ফরেন কারেন্সি।

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জেলাজুড়ে এ পান চাষ ক্রমেই বাড়ছে। এ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন পান চাষে ঐতিহ্যবাহী জেলা কুষ্টিয়ায় একসময় অব্যাহত লোকসানের কারণে পান চাষে বিমুখ হয়ে পড়েন চাষীরা। গত তিন অর্থবছরে পান চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন জেলার কৃষক। ফলে অনেক চাষী আবারো ঝুঁকছেন পান চাষে।

ওই দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে পান চাষ হয়েছিল ২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় ২ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ চাষ আরো সম্প্রসারিত হবে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বিগত দুটি অর্থবছরে এ জেলা পান রফতানিতে ভালো করেছে। জেলার তিনটি উপজেলা থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার পান রফতানি হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৬৭ টন পান লন্ডনসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রফতানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ২২ টন পান রফতানি হয়েছে।

অন্যদিকে বর্তমানে পান চাষে জৈব বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহার হওয়ায় একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসম্মত পান উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, তেমনি বেড়েছে ফলন। এতে কুষ্টিয়ার পানের কদর এখন দেশের গণ্ডি পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে। কুষ্টিয়ায় বাংলা পান, মিঠা পান, দেশী পান, ঝালি পান, সাচি পান, কর্পূরী পান, গ্যাচ পান, মাঘি পান, উজানি পান, নাতিয়াবাসুত পান, বরিশাল পান ও উচ্চফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধে সক্ষম বারি পান-১, বারি পান-২ এবং বারি পান-৩ ছাড়াও বেশ কয়েক জাতের পান চাষ হয়। এর মধ্যে বাংলা পান ও মিঠা পান খুবই জনপ্রিয়। বাংলা পান পাতা পচা, পাতা পোড়া ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধক্ষম হওয়ায় কৃষক এ পান চাষে বেশি ঝুঁকছেন।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এ অঞ্চলের কৃষকদের আধুনিক উপায়ে পানের বরজ সংরক্ষণ ও বরজে পান চাষে প্রশিক্ষিত করেছেন। সঠিক প্রক্রিয়ায় বালাইনাশক প্রক্রিয়া শিখিয়েছেন। এখন এ অঞ্চলের পানচাষীরা বিঘাপ্রতি ১ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাভ করছেন। কয়েক বছর আগেও যেখানে অধিক লাভের আশায় কৃষক তামাক চাষে নিয়োজিত ছিলেন, এখন তামাকের পরিবর্তে পান চাষে ঝুঁকছেন।

কুষ্টিয়ার চাষীদের মধ্যে পান বিক্রি করে দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন অনেকেই। এদের মধ্যে রয়েছেন মিরপুর উপজেলার হাজরাহাটি গ্রামের যুবক হাশেম আলী খান। নিজের আড়াই বিঘা জমিতে পান চাষ করে তার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তিনি জানান, প্রথমবার পানের বরজ করতে একটু বেশি খরচ হয়। কিন্তু পরেরবার চাষ করতে খরচ কম। এ বছর আড়াই বিঘা জমিতে পান চাষ করেছেন। আশা করছেন ৩ লাখ টাকার ওপরে তার লাভ হবে। হাশেম আলীর বরজে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন এলাকার আরো পাঁচ-সাতজন কৃষি শ্রমিক।

ভেড়ামারা উপজেলার কুচিয়ামোড়া এলাকার পানচাষী শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি আগে তামাক চাষ করতেন। দুই বছর ধরে তামাকের পরিবর্তে পান চাষ করছেন। এক বিঘা জমিতে বাংলা পানের চাষ করেছিলেন। সেখানে তার ১ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। প্রথমবার পানের বরজ করতে একটু বেশি খরচ হয়। কিন্তু পরেরবার চাষ করতে খরচ কম। এ বছর শহিদুল তিন বিঘা জমিতে বাংলা পান চাষ করেছেন। তিনি আরো জানান, স্থানীয় বাজার, কুষ্টিয়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ বাংলা পানের চাহিদা বেশি।

ভেড়ামারা উপজেলার পানচাষী আব্দুর রহমান দীর্ঘদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে পান পাঠান। ব্যয়বহুল ও দুর্গম যোগাযোগের কারণে লাভ হতো কম। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তিনি নিজেই দুই চালান পান ঢাকা, চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, এতে তার লাভ হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কুষ্টিয়ার পানচাষীরা পান উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ বিষমুক্ত প্রযুক্তি জৈব বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে পানচাষীরা ভালো ফল পেতে শুরু করেছেন। আর্থিকভাবেও বেশ লাভবান হচ্ছেন। এ জৈব বালাইনাশক পদ্ধতিতে পান চাষ করে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসম্মত পান উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, তেমনি আগের তুলনায় পানের ফলনও বেড়েছে। এ জৈব বালাইনাশক পদ্ধতির আওতায় হলুদ আঠালো ফাঁদ, তুঁতে, চুন ও পানির সংমিশ্রণ ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। জৈব বালাইনাশক ট্রাইকোডার্মা ফিজি মাইট, পোকা দমনে ইয়েলো স্টিকি ট্যাপ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে এখন পানচাষীরা সম্পূর্ণ নিরাপদ পান উৎপাদন করছেন।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বৃত্তিপাড়ার পানচাষী সাইদুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন এ অঞ্চলের পানচাষীরা প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করে বালাই দমন করে আসছিলেন। তিনি ও তার এলাকার অনেক কৃষক এ বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছেন।

যশোর অঞ্চলের টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, পান চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন কুষ্টিয়ার কৃষক। আধুনিক উপায়ে বাংলা জাতের পান চাষ করে বিঘাপ্রতি ১ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাভ করছেন তারা।

তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও যেখানে অধিক লাভের আশায় কৃষক তামাক চাষে ঝুঁকেছিলেন, এখন তারা পান চাষ শুরু করেছেন। কুষ্টিয়ার পানের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বিদেশী মুদ্রা আয়ে। জেলার পানচাষীদের জন্য বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।


লেখক: সাংবাদিক

আরও