পাট ও পাটজাত পণ্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল ধরে এ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৫০-৭০ সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যসামগ্রী রফতানি পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। ১৯৫১-৭০ সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত সামগ্রী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটকল মালিকরা মূলত পাকিস্তানি হওয়ায় এসব পাটকল রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বেসরকারি খাতে পাট ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণভাবে পাট কেনা ও পাটপণ্য উৎপাদনের দায়িত্ব বর্তায় নবগঠিত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ওপর। পাট রফতানির একচেটিয়া দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ পাট রফতানি সংস্থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের এসব পাটকলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ খাতে বিপর্যয় দেখা দেয়। আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাট শিল্পের ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে পাট শিল্পে নতুন দিনের সূচনা হয়। শুরু হয় বেসরকারি খাতে পাটকল স্থাপন। পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদি রফতানিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা স্বীকৃতি পায়। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কীভাবে পাট শিল্পে উন্নতি বয়ে আনে এবং দেশের অর্থনীতিতে এর অবদান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
আশির দশক থেকে বেসরকারি খাতে পাটকল স্থাপন এবং এগুলোর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাওয়ায় পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা দেশীয় পাটকলের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য তেমন অবশিষ্ট থাকে না। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক শূন্য ৯ লাখ বেল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাটের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৫৮ লাখ বেলে। বর্তমানে ৮০-৮৫ বেল পাট উৎপন্ন হচ্ছে। ২০১০ সালে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ফলে দেশে ও বিদেশে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাটের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি না পাওয়াই এর মূল কারণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি পাটের উৎপাদনশীলতা ছিল ১১ দশমিক ৮৪ বেল, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩২ বেল। দেশের আট বিভাগের মধ্যে পাট উৎপাদন সবচেয়ে বেশি কমেছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। দারিদ্র্যপ্রবণ এ দুটি বিভাগেই উৎপাদন কমেছে ২ লাখ ২৬ হাজার বেল। ফলে দেশের মোট উৎপাদন কমার প্রায় ৭০ শতাংশই এ দুটি বিভাগে। রংপুর বিভাগে পাট উৎপাদন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৭০৯ বেল এবং রাজশাহী বিভাগে কমেছে ১ লাখ ৪ হাজার ১২৭ বেল। এছাড়া তৃতীয় সর্বোচ্চ কমেছে খুলনা বিভাগে ৫৮ হাজার ৭৬১ বেল এবং ঢাকা বিভাগে কমেছে ৩৪ হাজার ৬৩৯ বেল।
দেশীয় পাটকলে তৈরি পাটজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। দেশে ও বিদেশে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানি করে আয় হয় ২৩০ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়ায় ২১৬ মিলিয়ন ডলারে। তবে পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় ঊর্ধ্বমুখী। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় হয় ৮০১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৭-১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৩ মিলিয়ন ডলারে।
২০২০ সালের ১ জুলাই সরকারি খাতের পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় পাট শিল্পের অগ্রগতি কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা পাটকলগুলোর মধ্য থেকে ১৭টি লিজ দেয়ার জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে বিজেএমসি। ১৪টি পাটকলের জন্য ৫১টি দরপত্র পড়েছে, যেগুলো পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলো সত্বর লিজ দেয়া হলে এগুলো উৎপাদনে এসে পাট শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ববাজারের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচা পাট এবং প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান পাট রফতানিকারক দেশ। পাট খাতের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের ৭২ শতাংশ বর্তমানে বাংলাদেশের দখলে। একক কৃষিপণ্য হিসেবে বর্তমানে জাতীয় রফতানি আয়ে পাট খাতের অবস্থান দ্বিতীয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
পাটপণ্য তৈরি একটা শ্রমঘন শিল্প এবং এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, যা কাঁচা পাট ব্যবসায় বহুলাংশে অনুপস্থিত। তবে যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে তা হলো কৃষক যেন পাটের ভালো দাম পান। তাই সরকারের উচিত হবে বিভিন্ন মানের কাঁচা পাটের দাম এমনভাবে নির্ধারণ করে দেয়া, যাতে উৎপাদন ব্যয় মেটানোর পরও পাটচাষীরা লাভবান হন। এতে পাটকল মালিক এবং পাট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে পাটচাষীদের কাছ থেকে কম দামে কাঁচা পাট কেনার সুযোগ পাবেন না।
সব শেষে যা বলতে চাই তা হলো উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেশে পাটের চাহিদা মেটাতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত মানের পাটবীজ সরবরাহ, চাষীদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের চাহিদা মেটানোর পরই পাট রফতানির বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে। এতে কৃষক, পাটকল মালিক, পাটপণ্য ক্রেতা, পাট ব্যবসায়ী সবাই উপকৃত হবেন। পাটজাত পণ্যসামগ্রী রফতানি প্রতিযোগিতায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকব।
লেখক: সাবেক খাদ্য সচিব