অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে চীন। এতে দরিদ্র পরিবার থেকে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন খাত উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু কোষাগার খালি হওয়ায় বাড়তি ব্যয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার। এ কারণে কর আদায়ে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশটি। সম্প্রতি সম্পদশালী ব্যক্তি ও কোম্পানিকে তাদের অনাদায়ী কর আছে কিনা তা নিরীক্ষণে পদক্ষেপ নিতে বলেছে চীন সরকার। এতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ অর্থনীতির ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা হুমকিতে পড়েছে বলে উঠে এসেছে এফটির এক প্রতিবেদনে।
মূলত সম্পত্তি বাজারে মন্দার কারণে চীনের স্থানীয় সরকারগুলোর কোষাগার এখন প্রায় খালি, তা পূরণ করতে তারা নতুন রাজস্বের সন্ধান করছে। নতুন নির্দেশনা অনুসারে, চীনে ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে করের হিসাব সেলফ-ইনসপেকশন বা নিজেদের পর্যালোচনা করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর অনাদায়ী থাকলে তা পরিশোধ করতে হবে।
চলতি সপ্তাহে চীন সরকারের বৃহৎ আর্থিক উদ্দীপনার বিস্তারিত ঘোষণা আসতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এখন স্থানীয় সরকারকে অর্থ পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করা হবে। এরই মধ্যে অনেক সরকারি সংস্থা সরবরাহকারী ও কর্মচারীদের অর্থ দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ চীনের গৃহস্থালি থেকে বিনিয়োগকারী পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবিত করেছে। অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, গত সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া উদ্দীপনা কর্মসূচির পরবর্তী ধাপ ভুক্তভোগীদের আস্থা পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করবে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশের তুলনায় কম হওয়ায় বেইজিং অর্থনৈতিক উদ্দীপনার এ পরিকল্পনা জানিয়েছিল।
চীনভিত্তিক কর-পরিষেবা দাতা একটি সংস্থা বলছে, কর আদায়ে নতুন নির্দেশনা বেইজিং, সাংহাই ও শেনজেনের মতো প্রধান শহরগুলোর ধনীদের মধ্যে অস্বস্তি, এমনকি ‘ভয়’ তৈরি করেছে। সংস্থাটি বলছে, ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলেই জানত না যে নিজস্ব পর্যালোচনা বলতে কী ঘোষণা করতে হবে। অনেকে আগে বুঝতে পারেননি যে বিদেশে অর্জিত ব্যক্তিগত মুনাফা চীনে করের অধীন হবে।’
সেলফ-ইনসপেকশন শব্দটিতে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে অনেকের মত। এর মধ্যে এক বিজ্ঞপ্তিতে সরকার বলছে, কোনো কোম্পানি নিজস্ব নিরীক্ষণে ভুল কিছু খুঁজে না পেলে স্ট্যাম্পযুক্ত প্রত্যয়নপত্র পাঠাতে হবে এবং সরকারি পরিদর্শনের জন্য প্রমাণগুলো বহাল রাখতে হবে।
কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশী বিনিয়োগ থেকে মুনাফাসহ অন্যান্য আয়ের মধ্যে ব্যাক-ট্যাক্স দিতে বলেছে। যদিও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান নেই, তবে ২০১৯ সালের এক অল্প-ব্যবহৃত আইনে এ ধরনের বিধান রয়েছে।
কভিড-১৯-পরবর্তী চীনে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে বাধা হয়ে দেখা দেয় সম্পত্তি বাজারের মন্দা। গত তিন বছরে এ খাত থেকে আয় কমায় স্থানীয় সরকারগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা পরিবার ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে ক্ষুণ্ন করেছে। এখন রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারগুলো বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বেসরকারি খাতে জরিমানা বৃদ্ধি ও সম্ভাব্য সব উপায়ে কর বাড়ানো।
চীন সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস জমি বিক্রি। কিন্তু ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের প্রথম নয় মাসে এ খাত থেকে আয় প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে দেশব্যাপী কর আদায় কমেছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারি তথ্যানুসারে, এ বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে চীনের রাজস্ব গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ কমে প্রায় ১৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন আরএমবি বা ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে।
আর্থিক সংস্থা নাটিক্সিসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ গ্যারি এনজি বলেন, ‘চীনের রাজস্ব ঘাটতি ভেঙে পড়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজে বের করা তাই আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ধনী ও কিছু কোম্পানির ওপর কর আরোপ বেশির ভাগ বাসিন্দার ওপর খুব একটা সরাসরি অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করে না।’
অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের কো-হেড খের শেং লির মতে, চীনের বিদ্যমান অর্থনীতিতে রাজস্ব সংগ্রহের কঠোরতা খুবই ব্যবহারিক পদক্ষেপ। কিন্তু চাপ বাড়তে থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমার ঝুঁকি তৈরি হয়।
এরই মধ্যে চীনে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি করের নতুন প্রতিবেদন দাখিল করেছে। যেমন হিসুন ফার্মাসিউটিক্যালস স্বনিরীক্ষণের সময় দেখেছে, কর ও ফি বাবদ ১ কোটি ৮০ লাখ আরএমবি বকেয়া রয়েছে। অ্যালজেন মেডিকেল ৮০ লাখ আরএমবি পরিশোধ করেছে।
অন্যদিকে চীনের ১৬টির মধ্যে সাতটি প্রদেশে গত বছর জরিমানা আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যেমন চংকিং ও বেইজিংয়ে বেড়েছে যথাক্রমে ২২ দশমিক ৪ ও ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার কিছু স্থানীয় সরকার অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ বৃদ্ধির কারণে জরিমানাসংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয়া বন্ধ রেখেছে।