দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত চিংড়ি শিল্পের। একসময় দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানি পণ্য ছিল চিংড়ি। কিন্তু গত কয়েক বছরে এটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে এখন শীর্ষ রফতানি পণ্যের তালিকায় সপ্তম।
রফতানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা ও রফতানিকারকরা বলছেন, বিদেশের বাজারে চিংড়ির দাম কমে যাওয়া, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, চিংড়িতে নানা অপদ্রব্য মেশানোয় সুনাম নষ্ট হওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ খাত থেকে মুনাফা কমছে, ফলে মাঠপর্যায়ে চাষে অনীহা বাড়ছে চাষীদের। তাছাড়া নোনা পানির কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের চরম বিপর্যয় তৈরি হওয়ায় চিংড়ি ঘেরের সংখ্যাও কমছে।
পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি (প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি) ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে জনপ্রিয় হওয়ায় দেশের চিংড়ি মার খাচ্ছে। রফতানিকারকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকার চিংড়ির ক্রেতারা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকায় ব্যয়ে কাটছাঁট শুরু করেছেন। ভেনামির তুলনায় বাগদা চিংড়ি কিনতে ২-৩ ডলার পর্যন্ত বাড়তি খরচ করতে হয়, বিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা ভেনামির দিকেই ঝুঁকছেন বেশি।
চিংড়িচাষীরা বলছেন, গত কয়েক বছর জলবায়ুর প্রভাব-প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগবালাইসহ নানাবিধ কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প চরম সংকটে। চিংড়ির পোনা, খাদ্য, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ সব খরচ বাড়লেও উৎপাদিত চিংড়ির দাম সেভাবে বাড়েনি। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন মূলধনই টিকছে না প্রান্তিক চাষীদের। ঋণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ফলে ‘জীবিকা নিয়ে সংকট’র চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই।
চাষীদের অভিযোগ, চিংড়ি শিল্প পুরোটাই বেসরকারি সিন্ডিকেটের দখলে। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজি করে চাষীদের কম দামে চিংড়ি বিক্রি করতে বাধ্য করে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ির ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ অপচেষ্টা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ছে। সম্প্রতি খুলনাঞ্চল থেকে রফতানি করা সাত কনটেইনার চিংড়িতে ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়ায় তিন কনটেইনার চিংড়ি ফেরত পাঠিয়েছে আমদানিকারক দেশ ইউরোপ ও আমেরিকা।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, খুলনার কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘খুলনাঞ্চল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানি করা চিংড়িতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, লোহার স্ক্রু ও সিরিঞ্জের নিডল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানির প্রায় তিন কনটেইনার চিংড়ি ফেরত এসেছে।’
লিপটন আরো বলেন, ‘চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ ও জীবাণুর উপস্থিতি থাকায় ২০০৯ সালে ইউরোপ বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। এরপর আবারো ওই ধরনের ঘটনায় তারা সতর্ক করেছে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিশারিজ অ্যান্ড ভেটেরিনারিজ অর্গানাইজেশন (ইভিএফভিও) অক্টোবরে বাংলাদেশ সফর করবে। এ সময় সংস্থার প্রতিনিধি দলটি খুলনা-সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের খামার, ডিপো ও হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানাগুলো পরিদর্শন করবে।’
তবে চিংড়িচাষীরা বলছেন, চাষী পর্যায়ে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয় না। কাজটি সাধারণত করা হয় ডিপো পর্যায়ে। তারা চাষীদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনে শ্রমিকদের দিয়ে জেলি পুশ করে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠায়।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল বাকী বলেন, ‘চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ ও জীবাণুর উপস্থিতি রফতানি খাতের জন্য অশনিসংকেত। তাছাড়া বিশ্ববাজারে চিংড়ির ক্রেতারা এখন কম মূল্যের কারণে ভেনামি জাতের চিংড়ির দিকে ঝুঁকেছে। আমাদেরও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ চিংড়ি চাষের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এখন বাজার ধরে রাখতে বাণিজ্যিকভাবে এ চিংড়ি চাষ বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্যমতে, সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে চিংড়ি রফতানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশ থেকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করা হয় ৪০ হাজার ৭০২ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৭০৬, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ১৬৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৩০৬, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৭১ টন।
কয়েক বছরের গড় রফতানির হার কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ করে। এ অবস্থা চলতে থাকলে চিংড়ি রফতানি তলানিতে এসে ঠেকার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ কোটি ডলার। তবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) চিংড়ি রফতানিতে আয় কমেছে ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।’ সর্বশেষ তথ্য এখনো সমন্বয় করা যায়নি বলে জানান এ ব্যবসায়ী সংগঠক।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ খুলনার উপপরিচালক মো. আবু ছাইদ জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে খুলনা অঞ্চল থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় হিমায়িত চিংড়ির রফতানি কমেছে চার হাজার টন। ইউরোপীয় দেশগুলোয় চাহিদা কম থাকায় হিমায়িত চিংড়ির রফতানি কমেছে। তবে সম্প্রতি চীনে বাংলাদেশী চিংড়ির বাজার তৈরি হয়েছে।
চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চিংড়ির শরীরে যে অপদ্রব্য পুশ করা হয়, তা আসলে রাসায়নিক নয়। এ কারণে তা পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। যদি কখনো পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাহলে তা বাতিল করা হয়।’
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, ‘আশির দশকে খুলনা এলাকায় লবণাক্ত পানিতে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয় খুলনাঞ্চলে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস চিংড়ি চাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৮৫ শতাংশ রফতানি হয় ইউরোপে, ৭-৮ শতাংশ আমেরিকায় এবং বাকিটা জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যে। তবে কয়েক বছর খুলনাঞ্চল থেকে হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতে ভাটা পড়েছে।’
জয়দেব বলেন, ‘আগে খুলনাঞ্চলের চাষীরা ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ করলেও এখন আর আগের মতো উন্মুক্ত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হয় না। এখন চিংড়ি চাষে নোনা পানি ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। এতে দেশের রফতানির এ খাত মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায়। ফলে সময় এসেছে চিংড়ি চাষের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৎস্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সব সেক্টরের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের।’
তিনি বলেন, ‘অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি উৎপাদনের জন্য চাষীদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত।’
লেখক: সাংবাদিক