মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলাকে বলা হয় আগর-আতরের আঁতুড়ঘর। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, এ এলাকায় আগর চাষের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের। ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘হর্ষ চরিত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে এ গ্রন্থের রচয়িতা আসামের মহারাজা বর্মণের কাছ থেকে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থেকে সংগৃহীত আগর কাঠ ও তরল আতর উপহার পেয়েছিলেন। কথিত আছে, রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করার পর হজরত শাহজালাল (রা.) রাজভাণ্ডার থেকে মূল্যবান আগর কাঠ ও আতর পেয়েছিলেন। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজল আল্লামী রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে আগর কাঠ, আগর তেল এবং আগর থেকে আতর আহরণের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বড়লেখায় আগর চাষের বিস্তার ও ব্যবসা সুসংগঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। সেসব কারণে মৌলভীবাজারকে আগর-আতরের জেলা বলা হয়। বড়লেখা ছাড়াও জেলার কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলায় বর্তমানে আগরের চাষ হচ্ছে। বাড়ির আঙিনা থেকে এই চাষ এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৫ সালে শিল্প হিসেবে ঘোষণার পর বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। আগর-আতর শিল্পের সঙ্গে মৌলভীবাজারের ৪০-৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে। বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা, রফিনগর, হাসিমপুর, চিন্তাপুর, বড়থল গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম এবং পাথারিয়ার পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগরের চাষ হয়ে থাকে। বাগান তৈরির পাশাপাশি বসতবাড়ির আশপাশে গাছ লাগানো হয়েছে। ছোট, বড়, মাঝারি প্রতিটি আগর গাছই মূল্যবান।
স্থানীয়রা জানায়, আগর বাগান তৈরি ছাড়াও অনেকে নার্সারি করে আগর গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রি করেন। এক শ্রেণীর শ্রমিক শুধু গাছে লোহার পেরেক মারার কাজ করেন। কারণ আগর গাছে লোহার পেরেক মারার কাজটি করতে হয় দক্ষ হাতে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা কারখানায় কাজ করেন অনেকে।
সুজানগরের আগর চাষী মো. আব্দুল আজিজ জানান, সুজানগর গ্রামটি এরই মধ্যে আগর-আতরের গ্রাম হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। বংশপরম্পরায় এ গ্রামের মানুষ আগর-আতর শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পুরো প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করে থাকেন। গত কয়েক বছরে দেশ-বিদেশে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পটির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন অনেকে। আশপাশের এলাকায়ও গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বাগান ও কারখানা। বদলে দিয়েছে অনেকের জীবন।
সম্প্রতি সুজানগর গিয়ে দেখা যায়, গ্রামীণ রাস্তার দুপাশে সারি সারি আগরগাছ। সচ্ছলতার ছাপ রয়েছে ঘরবাড়ির চেহারায়। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে কারখানা। গ্রামের পথ ধরে হাঁটলেই নাকে আসবে আগর-আতরের সুঘ্রাণ। বাড়ির উঠানের এক পাশে ফালি ফালি করে কাটা হচ্ছে আগরগাছ, আরেক পাশে চলছে কাটা টুকরো থেকে পেরেক খোলার কাজ। ঘরের বারান্দায় বসে নারীরা করছেন ফালি কেটে ছোট টুকরা করার কাজ। কারখানায় শ্রমিকরা সারি বাঁধা ডেকচিতে আগর জ্বাল দিচ্ছেন। জ্বাল দেয়া কাঠের টুকরো থেকে সনাতন প্রক্রিয়ায় যে নির্যাস বের করা হবে তা আতর তেল।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে প্রায় আড়াইশ ছোট ও মাঝারি আগর-আতর কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে আছে আরো প্রায় ৫০টির মতো। তবে বন বিভাগের তথ্যমতে জেলায় নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ১৭৬। ছোট ছোট প্রায় অর্ধেক কারখানা অনিবন্ধিত।
আগর থেকে আতর সংগ্রহের পদ্ধতিটি বেশ প্রাচীন বা সনাতন। আগরগাছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ক্ষতে কষ জমা হয়। গাছ কেটে ক্ষতস্থান বেছে নিয়ে ডেকচিতে জ্বাল দিয়ে উৎপাদন করা হয় আতর আর কাঠগুলো সুগন্ধি আগর। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে গাছে কখন ক্ষত হবে এজন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো। উৎপাদনের এ প্রাকৃতিক উপায়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই এখানকার মানুষ আবিষ্কার করে বর্তমান পেরেক মারা পদ্ধতি। ফলে সাত-আট বছরের মাথায় একটি আগরগাছ থেকে এখন আগর-আতর উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
এ প্রক্রিয়ায় গাছ লাগানোর পাঁচ-ছয় বছর পর পুরো গাছে এক ইঞ্চি পরপর লোহার পেরেক মেরে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়। তখন গাছ থেকে একধরনের রস বের হয়। পেরেকের চারপাশে সেই রস জমে কালো রং ধারণ করে। এভাবে কয়েক বছর রাখার পর গাছ কাটা হয়। ছোট ফালি করে কাটার পর পেরেক খুলে চিপস ও ছোট ছোট টুকরো করা হয়। চিপসগুলো ১৫ দিন থেকে এক মাস ড্রামের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সেগুলো স্টিলের ডেকচির মধ্যে দিয়ে অনবরত জ্বাল দেয়া হয়। তখন পাতন পদ্ধতিতে একটি নলের মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় আতর নির্দিষ্ট পাত্রে জমা হয়।
রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বে অব বেঙ্গল পারফিউমারির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আব্দুল কবির জানান, তাদের ১০-১২ বিঘা জমিতে আগর বাগান রয়েছে। কারখানায় ৮০ জন লোক কাজ করেন। ১৮টি মেশিনে মাসে গড়ে ৫০০ তোলা (এক তোলা আতর ১১ দশমিক ৬২ গ্রাম) আতর উৎপাদিত হয়। তরল আতর ও আগর কাঠ মিলে প্রতি বছর বিদেশে আড়াই লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে তাদের প্রতিষ্ঠান। জুলাইয়ে ৮০ হাজার ডলারের আতর এবং আগর কাঠ রফতানি করেছেন তারা। মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি প্রস্তুতকারক ও আতরের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে কাঁচা আতর কেনে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার উৎপাদিত কাঁচা আতর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভোক্তাদের কাছে জনপ্রিয়। চাহিদা ভালো থাকায় প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও রফতানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করে।
আগর কাঠের মানের তারতম্য অনুসারে এগুলোকে ডবল সুপার, আগর প্রপার, কলাগাছি আগর ও ডোম আগর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পরিপক্ব আগর গাছের প্রতি কেজি কাঠ ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর সাধারণ কাঠ মানভেদে দুইশ থেকে হাজার টাকায়। আর স্থানীয়ভাবে প্রতি তোলা (এক তোলা আতর ১১.৬২ গ্রাম) কাঁচা আতর মান অনুযায়ী ৬ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম আরো বেশি।
বর্তমানে দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রফতানি হচ্ছে। কুয়েত, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের কয়েকটি আগর-আতর কারখানা আছে। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে ভালো মানের পণ্যের জোগান কম।
তারা আরো জানান, বাংলাদেশে সরাসরি আতর থেকে পারফিউম তৈরি হচ্ছে না। অথচ এখান থেকে আমদানীকৃত কাঁচামাল দিয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন জাতের সুগন্ধি তৈরি করে বিশ্ববাজার দখলে রেখেছে। এছাড়া ইউনানি ওষুধ তৈরির জন্য ক্যাস্টর অয়েলকে আগরের মেশিনে রিফাই করে আগরের সুগন্ধযুক্ত এক প্রকার তেল তৈরি করা হয়। যাকে আগর উডের কম্পাউন্ড অয়েল বলে। এ তেলের বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও চীন। প্রতি কিলোগ্রাম তেল ২-৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আবার ইউরোপের কিছু প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশ থেকে কাঁচা আতর কেনে। তারা বিভিন্ন ফুলের ফ্লেভার দিয়ে বিভিন্ন মানের সুগন্ধি তৈরি করে। সুজানগরের আগর-আতর শিল্পকে ঘিরে সুগন্ধি কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরি করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দাবি তাদের।
আগর-আতর ব্যবসায় জড়িত জেলার মোটামুটি বড় মানের ১০৪ জন ব্যবসায়ীকে নিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন। এদের মধ্যে অন্তত ৭০ জন এসেছেন ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতায়।
এ সংগঠন সূত্র জানায়, মৌলভীবাজার জেলা থেকে বছরে আনুমানিক পাঁচ হাজার লিটার কাঁচা আতর এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার কেজি আগর কাঠ বিদেশে রফতানি হয়। শুধু বড়লেখায় বছরে প্রায় চার হাজার লিটার আগরের নির্যাস উৎপাদিত হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার তরল আতর ৬ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৪ লাখ টাকা দরে রফতানি হয়। তবে উচ্চ দামের আতর উৎপাদন কম হয়। এর বাইরেও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া যাত্রীদের মাধ্যমে কিছু পণ্য সেখানে যায়। যা রফতানি হিসাবের বাইরে থাকে। এসব পণ্য বিদেশে নিয়ে সরাসরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয়। সেই অর্থ আবার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসে।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনসারুল হক জানান, আগর-আতর রফতানির ক্ষেত্রে সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পিসিস অব ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা) সনদ হলো অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এ সনদ সংগ্রহ করার ঝামেলা এড়াতে অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে নিজেরা আবার কখনো যাত্রীদের মাধ্যমে কিছু পণ্য বিদেশে পাঠান। তবে এটাকে অবৈধ বলা যাবে না, কারণ সেই অর্থ আবার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসে।
তিনি আরো জানান, প্রতি বছর এ খাতে ৫০০-৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। রফতানির ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দরকার। জ্বালানি এ খাতে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে গ্যাসের দাম বেশি। প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৩০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে হয়। আবার নতুন কারখানার জন্য গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নতুন করে কেউ উৎপাদনে আসতে পারছে না। পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আতর উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এখানকার কারখানাগুলো অনেক ছোট, সবার পক্ষে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে রফতানিও সম্ভব নয়। ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে সরাসরি পণ্য রফতানি করে। আগর-আতর শিল্পের জন্য নীতিমালা গ্রহণ এবং মৌলভীবাজারে একটি আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো সরকারের ভাবনায় রয়েছে জানিয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে অবহিত করা হবে। তাদের সমস্যা ও দাবিগুলো যাতে পূরণ হয় সেই চেষ্টা করব।’
লেখক: সাংবাদিক