ভারতের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ইতিবাচক অবস্থানে ছিল। কিন্তু গত মাসে বাজার থেকে ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি সরিয়ে নিয়েছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা, যা কভিড-১৯ মহামারীর পর এক মাসে সর্বোচ্চ পুঁজি সরিয়ে নেয়ার ঘটনা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের অর্থনীতিতে সৃষ্ট মন্থরগতির প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এতে অবসান হতে চলেছে দীর্ঘ ঊর্ধ্বমুখিতার। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।
ভারতীয় রুপির বিনিময় হার গত মাসে ডলারের বিপরীতে রেকর্ড নিচে নেমে আসে। একই সময় বিদেশী বিনিয়োগকারীও ভারতীয় পুঁজিবাজারের ওপর আকর্ষণ হারান। এতে দেশটির প্রধান দুই পুঁজিবাজার সূচক গত মাসে ২০২০ সালের মার্চের পর সর্বনিম্নে চলে যায়। অথচ এক মাস আগেও এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল ও আকর্ষণীয় পুঁজিবাজার ছিল।
ভারতের পুঁজিবাজারের আকার ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় তিন গুণে পৌঁছেছে। তবে দেশটিতে করপোরেট আয় কমে যাওয়া, অর্থনীতিতে মন্থরগতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণদানের সীমা কমিয়ে আনা বা নিয়ন্ত্রণের কারণে আবারো পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
মুম্বাইভিত্তিক মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্সের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা সৌরভ মুখার্জি বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতিতে এটি বেশ পরিচিত ঘটনা। এখন প্রশ্ন হলো, এ নিম্নমুখিতা কয়েক প্রান্তিকের জন্য স্থায়ী হবে, নাকি আরো দীর্ঘ হবে।’
সৌরভ তথ্যপ্রযুক্তি বা ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের তুলনামূলক নিরাপদ শেয়ার কিনছেন। তার বিশ্বাস, অনিশ্চয়তার সময়গুলোয়ও এ ধরনের শেয়ার ভালো পারফর্ম করতে পারবে।
অন্যদিকে মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় লেনদেনের গতি কমিয়ে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি সরকারি প্রণোদনার খরচে চীনের পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়েছে। সরিয়ে নেয়া অর্থ চীনা পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগ করতে পারেন ব্যবসায়ীরা।
সূত্র বলছে, গত অক্টোবরে সর্বোচ্চ পুঁজি সরিয়ে নেয়ার ঘটনার পর চলতি বছর পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এমনকি বছরের শুরুতে বিনিয়োগের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও গত মাস নাগাদ তা ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। অবশ্য একই সময় ভারতীয়দের খুচরা বিনিয়োগ বেড়েছে।
পুঁজিবাজারের নিম্নমুখিতার ইঙ্গিত গত আগস্টে পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন পর্যন্ত তিন মাসে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা গত পাঁচ প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে ধীর। গত মাসে নোমুরার অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করেন, ভারতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়।
চলতি বছর একাধিকবার রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল ভারতের ব্লু-চিপ শেয়ারের সূচক নিফটি ৫০। গত মাসে সূচকটির ৬ দশমিক ২ শতাংশ পতন হয়। এছাড়া সেনসেক্সও ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যায়। গত মাসে সূচকটি ২০২০ সালের মার্চের পর সবচেয়ে খারাপ মাস পার করেছে। তবে তুলনামূলক ইতিবাচক ছিল এমএসসিআই ইন্ডিয়া সূচক। সেখানে ১ ডলার আয় করতে ব্যবসায়ীরা প্রায় ২৪ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রে এসঅ্যান্ডপি৫০০ মার্কেটে ২৩ ডলারের মতো ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলেন বিনিয়োগকারীরা।
শিল্প খাতের আয় কমাও ভারতের পুঁজিবাজার পতনের আরেকটি কারণ। গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, দেশটির অধিকাংশ কোম্পানিই প্রত্যাশার চেয়ে কম আয় করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের ইকুইটি রেটিং ‘ওভারওয়েট’ থেকে’ ‘নিউট্রালে’ নামিয়ে এনেছেন।
ইউবিএসের প্রধান উদীয়মান বাজার কৌশলবিদ সুনীল তিরুমালাই বলেন, ‘আমরা আয়ের অবনমনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করি। ভারতে যা দেখা যাচ্ছে, তা বেশ তীব্র। এমনকি কিছু ভোক্তা পণ্যের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না।’
তথ্য বলছে, ভারতীয় ভোক্তাদের আস্থা ধীরে ধীরে কমছে। গত কয়েক মাসে ভারতীয় গাড়ি বিক্রি কমেছে। হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সিএফও রিতেশ তিওয়ারি বিশ্লেষকদের বলেন, ‘শিল্প খাতে চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমেছে।’
ভারতে নিম্নমুখী হলেও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে চীনের পুঁজিবাজার। সম্প্রতি আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। এ খবরে মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে চীনা বিনিয়োগকারীদের। এর আগে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ে চীনের তুলনায় বেশি আশাবাদী ছিলেন। এখন তারা আবারো চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন।
বাজারের এ পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে মনে করেন লুমিস সেলসের বৈশ্বিক উদীয়মান বাজার ইকুইটিজের প্রধান আশীষ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি না প্রণোদনা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন সমস্যার সমাধান করবে। কারণ চীনের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য ধার করা অর্থের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।’