জাতিসংঘ ঘোষিত পারিবারিক চাষাবাদ দশক উপলক্ষে ৩১ জুলাই ২০২১ তারিখে এএলআরডি ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে ‘পারিবারিক কৃষি, ছোট ও বর্গাচাষীদের সংকট ও সমাধান: সরকারের নীতি ও তার বাস্তবায়ন’ শীর্ষক একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে এ ক্রোড়পত্র
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ
সম্পাদক
বণিক বার্তা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এ বছরে আমরা ‘পারিবারিক কৃষি, ছোট ও বর্গাচাষীদের সংকট ও সমাধান: সরকারের নীতি ও তার বাস্তবায়ন’ বিষয়ের ওপর আলোচনা করছি। স্বাধীনতার পর থেকে গত পঞ্চাশ বছর ধরে উল্লিখিত বিষয় নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তার পরও বিষয়টি ঘিরে আমাদের বারবার আলোচনা করতে হয়। এর প্রধান কারণ বর্গাচাষী ও ছোট কৃষক আমাদের কৃষির মেরুদণ্ড। আমাদের মোট কৃষি পরিবারের অর্ধেকটাই হলো কৃষক বা বর্গাচাষী। তাদের মূল সমস্যা হিসেবে যে বিষয়টি দেখা যায়, তা হচ্ছে কৃষক ও বর্গাচাষীদের অধিকাংশই বোরো ধান নির্ভরশীল। গবেষণাতে দেখা গেছে, বোরো ধান এখন কৃষকদের জন্য আর লাভজনক অবস্থায় নেই। ফলে ছোট কৃষক বা বর্গাচাষী বা এর ওপর নির্ভরশীল এক কোটি যে পরিবার আছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্রমেই আরো প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে ঋণগ্রস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। জীবনধারণের জন্য যেটুকু আয়ের সংস্থান প্রয়োজন কিংবা পরিবারের সবার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা ও চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য যে অর্থসংস্থান দরকার পারিবারিক কৃষিকাজ করে এটা উপার্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, আমাদের দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক আবহে তারা উপেক্ষিত থাকছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের কথা পৌঁছাচ্ছে না। ফলে আগামী এক দশকে এসব ছোট কৃষক ও বর্গাচাষীদের ভবিষ্যৎ কী হবে।
খুশী কবির
সমন্বয়ক, নিজেরা করি
চেয়ারপারসন, এএলআরডি
সারা বিশ্বে পারিবারিক কৃষি পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে করপোরেট পুঁজির আধিপত্য। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে আমলে নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পারিবারিক কৃষি কিন্তু টেকসই ভূমিকা পালন করে। আমরা যদি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, তাহলে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব যে পারিবারিক কৃষি আমাদের সামনে এগিয়ে চলার একটি পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের বড়সংখ্যক একটি জনগোষ্ঠী পারিবারিক কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বোরো ধান উৎপাদনের পাশাপাশি অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে আমরা দেখছি, এজেন্টরা এসে তাদের ঋণ, বীজ সরবরাহ করার পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতেরও নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ফলে এ কৃষকরা বাণিজ্যিক খামারের দিকে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে কৃষকের হাতে আর নিজের পছন্দ ও প্রয়োজনমাফিক শস্য উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। আরো একটি বিষয় আমরা দেখছি, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। এখানেও নজর দেয়া প্রয়োজন। কৃষির বৈচিত্র্যকরণ, বীজ সংগ্রহকরণ প্রভৃতি কাজগুলোর সঙ্গে নারীরা নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এসব মিলিয়ে পারিবারিক কৃষি, ছোট ও বর্গাচাষীদের প্রসঙ্গটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
রওশন জাহান মনি
উপপরিচালক
এএলআরডি
কৃষিজ কর্মকাণ্ডে প্রধান কুশীলব হয়েও নারীর কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, নারী উন্নয়ন নীতি ও কৃষিনীতিতেও স্পষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি। কৃষি উৎপাদনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ও সরকারি ভূমিতে তাদের যৎসামান্য কার্যকর মালিকানা (৪-৫%) রয়েছে। নারীর নামে জমি না থাকা এবং কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকার কারণে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নারীরা প্রয়োজনীয় ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না। খাসজমি বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী অগ্রাধিকার তালিকায় নারীর যৌথ মালিকানার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্রসন্তানসহ আবেদনের কথা বলা হয়েছে, যা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক।
বিভিন্ন সময় সরকার বর্গাচাষী ও ভূমিহীন চাষীদের জন্য বিনা সুদে ঋণ দেয়ার কথা বললেও প্রকৃত চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণপ্রাপ্তিতে তারা বঞ্চিত থেকে যান। ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে বর্গা চুক্তিপত্র জমা দিতে হয়, যা তাদের পক্ষে জমা দেয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষীকে জমির মালিক জমি বর্গা দেন না। আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হলে তাদের ঋণের নতুন বোঝা তৈরির শঙ্কাও রয়েছে। অন্যদিকে সরকারের সুবিধা, বিশেষ করে সার-বীজ ও কৃষি উপকরণ প্রাপ্তিতেও তারা প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন। যদিওবা অনেক পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করেন কিন্তু উৎপাদিত ফসলের বাজারমূল্য তাদের অনুকূলে থাকে না। দেনার দায়, সংরক্ষণাগারের অভাব ও পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য তারা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য তারা পান না।
কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, কৃষক পরিচয়ে সামাজিক মর্যাদা না পাওয়া, কৃষিপণ্যের অনিশ্চিত ন্যায্যবাজার, নানামুখী অভিবাসন এবং পরিবেশগত ও জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কারণে যুবসমাজ আজ কৃষি পেশা ছেড়ে শহরমুখী নানা জীবিকা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে যুবদের জন্য কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করে কৃষি পেশার সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকের স্বার্থ রক্ষা ও ভূমি সঠিকভাবে ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং বাড়ানো সম্ভব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যাতে খালি পড়ে না থাকে এবং আরো বলেছেন, কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না। খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতে কৃষিকে লাভজনক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠায় খাসজমি বণ্টন, জোনিংসহ বেহাত হওয়া কৃষিজমি উদ্ধার এবং সুরক্ষার পাশাপাশি ছোট, পারিবারিক চাষী, বর্গাচাষীদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা দেয়া জরুরি। কৃষকের ইউনিয়নভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। নারী কৃষক, ছোট ও বর্গাচাষী এবং জুমচাষীদের উৎপাদিত ফসল যাতে তারা ন্যায্যমূল্যে বাজারে স্বাধীনভাবে বিকিকিনি করতে পারেন, তার জন্য বাজারে তাদের অভিগম্যতা ও নিরাপত্তা অগ্রাধিকার হিসেবে কৃষিনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তা বাস্তবায়নে জেলা, উপজেলা পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিতে হবে।
প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনায় সরকারের রক্ষাকবচ দুর্বল হওয়ার কারণে প্রান্তিক আদিবাসী পরিবারগুলো তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি, বন ও পাহাড় থেকে প্রতিনিয়ত বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মন্থর হওয়ায় এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় আদিবাসীরা স্থানীয় কর্মকাণ্ডে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সমন্বয়কারী প্রকল্প এবং সামাজিক বনায়ন, শিল্পায়ন, পর্যটন, রাস্তা নির্মাণ ও ইকোপার্কের নামে এসব আদিবাসী পরিবারকে তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা চলছে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের রক্ষাকবচ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯৭ ধারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর করতে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে সমতলের আদিবাসীরা জমি হারাচ্ছে।
ড. মোহাম্মাদ নাজিমুদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
পরিবার সবচেয়ে আদিম ও প্রাচীনতম সংগঠন, যার মাধ্যমে কৃষির যাত্রা। কৃষি মানুষের সংস্কৃতি। গত ১২ হাজার বছরে কৃষি পরিবারের সদস্য দ্বারাই কৃষির বিকাশ হয়েছে। কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শিল্প ও নগরসভ্যতা। উন্নত দেশগুলোয় কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। একে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। কৃষির এ রূপান্তরে পারিবারিক কৃষির অবদান কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। এ উপমহাদেশে কৃষিকে তৃতীয় শ্রেণীর পেশা মনে করা হয়। নানা বৈরী সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে এ দেশের কৃষকরা খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে অভাবনীয় অবদান রেখে চলেছেন। কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্ব যখন স্তব্ধ তখন এই ক্ষুদ্র কৃষকরা কোনো ধরনের প্রণোদনার মুখাপেক্ষী না থেকে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করছেন। এমন বাস্তবতায় দেশে কৃষি পেশা আজ মর্যাদার শীর্ষে। কয়েক দশক ধরে কৃষির এ পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে কৃষি পরিবার ও আমাদের ক্ষুদ্র চাষীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কৃষিতে রয়েছে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এত কিছুর পরও কৃষি থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে কৃষক পরিবারের খরচ চলে না। তাদের বিকল্প পেশায় যেতে হয় কিংবা অন্যের জমি বর্গা নিতে হয়। আবহাওয়া, জলবায়ু আর বাজার অনুকূলে থাকলে হয়তো পারিবারিক উন্নতি হয়। কিন্তু এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষিবাজারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সে উন্নতি স্থায়ী হয় না। ফলে পারিবারিক ব্যয় মেটানোর এমন কঠিন বাস্তবতায় কৃষককে কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যকে কৃষির পাশাপাশি কখনো অন্য পেশায় সম্পৃক্ত হতে হয়। ক্ষুদ্র চাষীরা পুঁজি ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে যদি পিছিয়ে যান, তাহলে উৎপাদন দক্ষতা কমবে। প্রধানমন্ত্রী কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতি জোর দিয়েছেন। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ প্রণয়ন হয়েছে। এর লক্ষ্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও লাভজনক কৃষি। সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে এরই মধ্যে ডেল্টা প্ল্যান করা হয়েছে। আমাদের কৃষির বর্তমান চ্যালেঞ্জ হলো ৫০ বছরে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। এখানে প্রধান অন্তরায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত। পাশাপাশি রয়েছে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়া। অনেক জমি পতিত রয়েছে। এদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের কৃষিনীতির অন্যতম লক্ষ্য কৃষির বাস্তুসংস্থান রক্ষা করা। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র চাষীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এটি করা সম্ভব। পাশাপাশি জৈব সারসহ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সম্প্রসারণে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা দরকার।
ড. আইনুন নাহার
অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কৃষিকে যখনই আমরা শুধু অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সীমিত আকারে বুঝতে চেষ্টা করব, তখন এর এক ধরনের অর্থ হবে। আবার যদি বৃহত্তর পরিসর থেকে এর বহুমাত্রিক দিকগুলো বোঝার চেষ্টা করি তখন এর গুরুত্ব আরো বেশি হবে। আমরা যখন বলি কৃষকসমাজ, কৃষি ব্যবস্থা বা কৃষিকাজ, তখন সমরূপী সত্তা হিসেবে কৃষককে বিবেচনা করি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে কৃষি শুধু একটি সেক্টর নয়, এর মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা খাত আছে। এখানে ছোট-বড় কৃষক, বর্গাচাষী, আদিবাসী আর নারীরা আছেন। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে এখানে যুক্ত। তাই আমরা যখন কৃষির কথা বলি তখন বুঝতে হবে আমরা মূলত কাদের কথা বলছি। এখানে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থা থেকে যারা যুক্ত আছেন, তাদের প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। আমরা যখন আদিবাসীদের কথা বলব তখন এক ধরনের প্রেক্ষাপট, আবার যখন নারীদের কথা বলব তখন আরেক ধরনের প্রেক্ষাপট থেকে বলব। আমি প্রশ্নটা এ কারণে উত্থাপন করছি যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন ও পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে। আবার অনেক কিছুই এখনো গ্রহণ করা হয়নি। যেমন কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবস্থা আইন। ২০১১ সাল থেকে এটি এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে। দশ বছরেও কেন আইনটিকে আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি? কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন বা পলিসিগুলোর ক্ষেত্রে কেন আমরা দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করছি, এর কারণটা কী? এর পেছনে কী ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর, আজও আমরা কেন এত অর্থনৈতিক সংকট দেখতে পাই, বৈষম্য ও বঞ্চনার কথা শুনতে পাই। কৃষির বিষয়টাকে আমি একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধু কৃষকবান্ধব ছিলেন। ক্ষুদ্র কৃষককে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক মতাদর্শিক যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেখানে আমরা দেখতে পাই নব্য উদারনৈতিক ব্যবস্থায় করপোরেটদের দাপট। তারা জমি, কৃষি থেকে শুরু করে ক্রমে সবকিছু দখল করছে। ফলে প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন আমাদের ক্ষুদ্র কৃষকরা। প্রান্তিক হয়ে পড়ছে আমাদের পারিবারিক কৃষি। জমি, বীজ, সার চলে গেছে করপোরেটদের অধীনে। রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে চাইলে মার্কেট বা করপোরেট তা দিতে চায় না। বড় বড় ঋণখেলাপিকে নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলি না। কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষক ঋণখেলাপি হলে তা নিয়ে কথা বলি।
আমাদের দেশে নারী কৃষক দিন দিন বাড়ছে। নারী কৃষকদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। ক্ষুদ্র কৃষকরা ধীরে ধীরে শ্রমিক, তারপর তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত করে আইনের সংস্কার করতে হবে। নারীদের সম্পদে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে। নারীর কৃষিজ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয়া এবং বিষয়টি রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
রুহিন হোসেন প্রিন্স
কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির দ্বিতীয় ভাগে পরিষ্কার করে বলা আছে, উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা, বণ্টন প্রণালিসমূহের মালিক ও নিয়ন্ত্রক হবে জনগণ এবং এ উদ্দেশ্যে মালিকানার ব্যবস্থা হবে। এখানে প্রধান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, দ্বিতীয় সমবায় মালিকানা, তৃতীয় ব্যক্তিগত মালিকানা এবং তা হচ্ছে আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা। এ ধারা তো সর্বত্রই বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষিতে ব্যতিক্রমের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যে অগ্রগতি ঘটছে, সে অগ্রগতির প্রধান তিন নায়কের একজন হলেন কৃষক। অন্য নায়করা হচ্ছেন বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক—এরা সবাই কিন্তু কৃষকের সন্তান। তার মানে সবার শিকড় কৃষি। এ নায়করাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ নায়কদের ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের কথা বলছি। কৃষিতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো যেমন আছে তেমনি গ্রামীণ কর্মসংস্থানও জড়িত। সেক্ষেত্রে যারা কৃষির সঙ্গে জড়িত, তাদেরই সবার আগে আমরা সুরক্ষা দেব। আজকের আলোচনায় উঠে এসেছে যে যারা ধনী কৃষক বা মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলেন, তারা কৃষিকাজের সঙ্গে আর সম্পৃক্ত নেই। বেশির ভাগই শহরে চলে এসেছেন। তাহলে কারা আছেন? তথ্য বলছে, ক্ষুদ্র, বর্গা ও চুক্তিভিত্তিক চাষীরা রয়েছেন। এ চাষীদের কী আছে এবং কী নেই—যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে আমি সহজে বুঝি যে তাদের শ্রম আছে, তারা কৃষির সঙ্গে লেগে আছেন কিন্তু তাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, পুঁজি নেই আর হয়তোবা সবার আধুনিক জ্ঞান নেই। আইনের সংস্কার দরকার। কোথাও সমবায় উদ্যোগ হতে পারে, আবার কোথাও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হতে পারে। প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে সেবা পৌঁছানোর জন্য যা করা প্রয়োজন, তা করতে হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পান তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদনের আগে কৃষকের খরচ কমাতে হবে এবং উৎপাদনের পরে লাভজনক দাম পান তার জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কৃষিজমি ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, অনেক আইন আছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিচ্ছেন কিন্তু আমরা দেখছি লাল তালিকার শিল্প সবুজ তালিকায় চলে যাচ্ছে। সুতরাং শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, কৃষিজমি রক্ষা ও প্রকৃত যারা কৃষির সঙ্গে জড়িত তাদের রক্ষা করেই বাংলাদেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। এছাড়া সরকার ভূমি ব্যাংকের কথা ভাবতে পারে। তাহলে ছোট ছোট অনাবাদি জমির ব্যবহার কৃষিতে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সমবায় খাতের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলো পরিকল্পিতভাবে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে এবং লক্ষ্য থাকবে ওই চার মূলনীতির অভিমুখী সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
ড. আবদুর রাজ্জাক
কৃষিমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষির আলোচনা করতে গেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা প্রথমে আসবে। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের আগে সত্তরের নির্বাচনের সময় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা চিরবঞ্চিত। এ বঞ্চনা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। এর একটা পরিবর্তন আনতে হবে। দেশটিতে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে হবে। এ কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। একইভাবে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে যে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানেও তিনি বলেছিলেন, আমার কাজের বিরাট অংশ জুড়ে থাকবে কৃষি। এর বাস্তবায়নও আমরা দেখি। স্বাধীনতার পর প্রথম বাজেটের আকার মাত্র ৭৮০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু ওই বাজেটেরও ৩১ শতাংশ কৃষিতে বরাদ্দ দিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি তিনি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি কৃষি উপকরণ এবং সেচের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেচের জন্য তিনি পানির পাম্প পূর্ব জার্মানি থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সারের দাম কমিয়েছিলেন এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সে সময় সমবায়ের কথা বলেছিলেন। আজকে খোলাবাজার অর্থনীতি এবং করপোরেট যে আধিপত্য, তার বাস্তবতায় সমবায় কতটা প্রবর্তন করা যাবে—এটি নিয়ে সংশয় থেকে যায়। রাজনৈতিক কাঠামো ও দর্শন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ ব্যবস্থায় ডব্লিউটিওর বাইরে কিছু করা যাবে না। তার পরও কৃষির জন্য প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তার ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। ১৯৯৬ সালের দিকে বিশ্বব্যাংক স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের নামে বলেছিল, বহুপক্ষীয় দাতাদের সাহায্য দিয়ে তোমরা কৃষিতে ভর্তুকি দিতে পারবে না। ভর্তুকি তোমাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে দিতে হবে। আমাদের অর্থ দিয়ে দিতে পারবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সেটা মানেননি।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করব। আমরা দেখলাম যে বোরো চাষ করে আমাদের ছোট চাষীরা, বর্গাচাষীরা লাভবান হচ্ছেন না। ধানের দাম এত কম, চাষীরা বিক্রি করতে পারছেন না। বর্গাদাররা কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছেন না, বরং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, কৃষি উপকরণের দাম আরো কমাতে হবে। তিনি কমিয়েছেন, যেন কৃষি লাভজনক হয়। আজকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কথা হচ্ছে। হাওর এলাকায় কৃষি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ফ্লাড ফ্লাশ এসে, বাঁধ ভেঙে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা এসব দুর্ভোগ তুলে ধরেছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমরা সেখানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে যেতে চাইছি।
এখানে যদি সমবায় থাকত, তাহলে সমবায়কে আমরা যন্ত্রটা দিতে পারতাম। সমবায় কিনে নিত এবং সবাই সমানভাবে ব্যবহার করত এবং উপকার পেত। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে সমবায়ের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। এ কারণে আমরা বাধ্য হয়েছি এ মেশিনগুলো ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করতে। শুধু মেশিন দিলে হবে না। এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এর স্পেয়ার পার্টসের দামও অনেক বেশি। একজন নিঃস্ব বর্গাচাষী সেটা কিনতে পারবেন না। বাস্তবতা হলো, কম্বাইন হারভেস্টার চাষীর ধান কাটায় সাহায্য করবে। এতে খরচটা কমে যাবে। উৎপাদন খরচ কমে যাবে, ধান চাষ লাভজনক হবে। বর্তমান বাজেটে প্রদর্শনী বাগান করার জন্য ৪৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের সচেতন করতে হবে। হাওর এলাকায় ৭০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে কৃষিযন্ত্র দেয়া হয়েছে। যদি ওই এলাকায় সমবায় সমিতি থাকত তাহলে কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে এ কৃষিযন্ত্রগুলো নিতে পারত। কিন্তু কৃষক সমবায় না থাকায় ব্যক্তি মালিকানায় যন্ত্রগুলো বিতরণ করা হয়েছে।
শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক
এএলআরডি
দীর্ঘদিন ধরেই আমরা দেশে একটি কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছি। এটা নিয়ে অনেক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও এটা নিয়ে একাধিকবার বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে এক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, সেভাবে এক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে না। এমনকি অনেক সময় সরকারি অনেক প্রকল্পের জন্যও এক, দুই কিংবা তিন ফসলি কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। সেটি হয়তো একটা বিশেষ কারণে হচ্ছে। কিন্তু সবটাই বিশেষ কারণ হলে বিশেষ কারণের আর মূল্য থাকে না। আর বেসরকারিভাবে তো অধিগ্রহণ হচ্ছেই। কৃষিজমি সুরক্ষা আইনটি যে আলোর মুখ দেখছে না, তার একটি কারণ ভূমি মন্ত্রণালয়। এর উদ্যোক্তাও আলোচ্য মন্ত্রণালয়। এটি যে পিছিয়ে গেছে, তাও ভূমি মন্ত্রণালয়ের কারণে। এ প্রেক্ষাপটে আমি কৃষিমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, আইনটি যেহেতু কৃষিজমি সুরক্ষার, সেহেতু এটি প্রণয়নের উদ্যোগটি তার মন্ত্রণালয় নিক। এজন্য নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি লাগবে। কিন্তু কৃষিমন্ত্রী চাইলে হয়তো তিনি সম্মতি আদায় করতে পারবেন। আমাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে।
বর্গাচাষীদের সমস্যা বেশ তীব্র। কতটা তীব্র তা সংশ্লিষ্টমাত্রই জানেন। সত্য যে বর্গা চাষের ধরনে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এটা উঠে গেছে। এখনো বহু এলাকায় ফসলে বর্গা হয়। আধাআধি বর্গা তো আছেই, তেভাগা বর্গাও আছে। অর্থাৎ মালিক দুই ভাগ আর চাষী এক ভাগ, যা নিয়ে ব্রিটিশ ভারতে গত শতকের চল্লিশের দশকে তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল। কৃষি এবং কৃষকদের রক্ষা করার জন্য কৃষক সংগঠনের দায়িত্ব আছে। কৃষক সংগঠন এবং কৃষক সমিতিগুলোকে সংগঠিত করে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সঠিক বাজারজাত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী বিলোপ করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে নারী কৃষক, ক্ষুদ্র কৃষক এবং আদিবাসীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। নারী কৃষক, ক্ষুদ্র কৃষক ও আদিবাসীদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।
য়েন য়েন
মানবাধিকারকর্মী ও উপদেষ্টা, চাকমা সার্কেল
রাঙ্গামাটি
গ্রামীণ আদিবাসীমাত্রই পরিবারভিত্তিক চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়-সমতল সবখানের আদিবাসীরা কৃষিকাজ করেই নিজেদের চাহিদা মেটান এবং সামান্য উপার্জন করেন। তাদের উৎপাদিত ফসলই কিন্তু গ্রামীণ আদিবাসীদের খাদ্যের জোগান দেয়। অন্য জায়গায় উৎপাদিত ফসলের ওপর নির্ভরশীল তাদের খুব একটা হতে হয় না। সব চাষীর মতোই আদিবাসী চাষীদের জীবন ও জীবিকার প্রধান উপাদান হলো ভূমি। অথচ আমরা দেখেছি পাহাড়ে এবং সমতলে আদিবাসীদের ভূমির কোনো সুরক্ষা নেই। সমতলের আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছেন ভূমিদস্যুদের হাতে। যে আইন তাদের সুরক্ষা দেয়ার কথা, সেটি তাদের যথাযথ সুরক্ষা দিচ্ছে না। কাজেই প্রজাস্বত্ব আইন নিয়ে আপত্তি তোলা উচিত। তবে যতক্ষণ এর বিকল্প আইন তৈরি না হয় ততক্ষণ অন্তত চেষ্টা করা উচিত যেন কোনোভাবে সমতলের আদিবাসীরা ভূমিহারা না হন।
বর্তমানে সামাজিক বনায়নসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। পারিবারিক কৃষি দশকে দুটো জায়গায় একটি অঙ্গীকার করা হয়েছে, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অভিগম্যতা নিশ্চিত করা হয়। সেটি সমতলের বননির্ভর পারিবারিক চাষী পরিবারকে আদিবাসীদের বাস্তবতায় কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা জরুরি। সেক্ষেত্রে বন আইনটা আদিবাসীবান্ধব করে সংস্কার করতে হবে।
এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, আদিবাসী কৃষকরা ঋণে জর্জরিত। আদিবাসী নারীরা ঋণে বেশি জর্জরিত, যদিও ভূমির ওপর তাদের কোনো অধিকার নেই। নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। একেকজন কয়েকটি এনজিও বা ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। একটি ঋণ পরিশোধ করতে আরেকটি ঋণ নেয়া হয়। এভাবে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে যদি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা যায়, তবে সেটি হবে একটি বড় সমাধান। পাহাড়ে-সমতলে সবখানে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হচ্ছে, তাতে পরিবর্তন আনা জরুরি।
সব চাষীর মতোই আদিবাসী চাষীদের জীবিকার প্রধান উপাদান হলো ভূমি। পাহাড়ি আদিবাসীরা সাধারণত জুমনির্ভর চাষী। অথচ আমরা দেখেছি, পাহাড়ে ও সমতলে ভূমিদস্যুরা কৃষকদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। এতে এখানকার কৃষকরা হুমকির মুখে রয়েছেন। বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের পারিবারিক কৃষিতে অবদান অনেক বেশি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। আদিবাসীদের প্রাকৃতিক সম্পদে অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসীদের উৎপাদিত ফসল ও ফলের তালিকা তৈরি করা এবং এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা— এ ধরনের সংলাপ ধারাবাহিকভাবে চালাতে হবে, যাতে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং পলিসি তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টিগোচর হয়। পারিবারিক কৃষির উদ্যোগের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে।
রাজেকুজ্জামান রতন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ
করোনাকালে ১১ হাজারের বেশি নতুন কোটিপতি হয়েছেন। আমি জানতে চাই কতজন ক্ষুদ্র কৃষক মাঝারি কৃষকে উন্নীত হয়েছেন? এর কোনো হিসাব আছে? নেই। কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, পুরুষদের মধ্যে মধ্যবয়সী আর বাকিটা নারী, এ সংখ্যাটা বাড়ছে। যুবকরা কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। কেন? কারণ শহরে এসে রিকশা চালালে নগদ টাকা পাওয়া যায়। আর গ্রামীণ কৃষিকাজে আর্থিক নিশ্চয়তা নেই। আবার ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা ক্ষেতমজুরদের ঠিকমতো মজুরি দিতে পারবেন কিনা এবং এ মজুরি দিয়ে তারা উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবেন না, বহু ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। কয়েকটি তথ্য তুলে ধরছি। আমাদের নাকি ৫৭ লাখ ছোটখাটো পুকুর বা ডোবা আছে। এগুলো আমরা পারিবারিক কৃষির মধ্যে নিয়ে আসতে পারি। এখানে সরকার যদি একটু প্রণোদনা দেয়, তাহলে কী হতে পারে? দেখা গেছে, আমাদের সাধারণ মাছে প্রতি শতকে ১৮০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। এগুলো আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি জোগাতে দারুণভাবে সহায়তা করতে পারে। এজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় এখন একটা নতুন চক্রান্ত শুরু হয়েছে। করপোরেট বনাম সমবায়। আমাদের সমবায় দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দেশটা দুর্বল যখন ছিল তখন ১৯৭২ সালে মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ বরাদ্দ ছিল কৃষিতে, সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কৃষির বিবর্ণ চেহারা দেখছি। আমাদের বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এখন কৃষিতে। কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি নয়, রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
শিরীন আখতার
সদস্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
পারিবারিক কৃষিতে রাষ্ট্র আমাদের কতটুকু সাহায্য করতে পারে, এটাই আজকের বড় প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু কৃষির ওপর জোর দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি না থাকে, অনাবাদি না থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে বাস্তব অবস্থা দেখা যাক। আমার ফেনীর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে চাই। ওখানে কৃষিজমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটার জন্য। আমি এর কোনো প্রতিকার করতে পারছি না। আমার এলাকায় অনেক প্রবাসী রয়েছেন, যারা বাইরে থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। কৃষিকাজে তাদের সন্তানদের আগ্রহ নেই। তারা যে পড়াশোনা করছেন, তাও কিন্তু নয়। ফলে তাদের জমিগুলো অলসভাবে পড়ে থাকছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠী কোথায় কীভাবে আছে, তাদের তালিকা করা দরকার। এ তালিকা করলেই মন্ত্রীর ঘোষিত ৪৩০ কোটি টাকা সঠিকভাবে বণ্টন সম্ভব হতে পারে। তা না হলে দেখা যাবে, যার কোনো জমিই নেই, বাড়িতে কোনো একটা বাগান করার মতো বা কৃষিকাজ করার মতো সুযোগ নেই, তাকে টাকা দিলে তা কোনো কাজেই লাগবে না। ফলে পরিকল্পনাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর সেখানে দরকার শক্তিশালী সংগঠন। এএলআরডি, কর্মজীবী নারী কিংবা কৃষক ক্ষেতমজুর সংগঠনের মতো সংগঠন। তাদের শক্তিশালী ও সচেতন করে তাদেরই মাধ্যমে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। সরকার যেসব সাহায্য পারিবারিক কৃষির জন্য দেবে, সেটি সত্যিকারের কাজে লাগছে কিনা এবং সেখান থেকে সুফল আসছে কিনা, সেটি দেখতে হবে।
আমাদের দেখতে হবে ছোট কৃষক, বর্গাচাষী, গরিব ও প্রান্তিক চাষী পরিবারগুলো রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে অসহায়ত্ব বোধ করে কিনা। এটা হলো সবচেয়ে বড় কথা। তারা যেন সরকারের দেয়া সুযোগগুলো খুশিমনে কোনো ধরনের উেকাচ ছাড়া, সংকট ছাড়া গ্রহণ করতে পারেন, ব্যবহার করতে পারেন—এটি নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য তাদের যেন কোনো দেনদরবার করতে না হয়। সেই কাঠামো আমরা কীভাবে তৈরি করব, সে ব্যবস্থা আমরা কীভাবে নেব, এর ওপর আমাদের বেশি জোর দিতে হবে। পারিবারিক কৃষককে অন্য কৃষকদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এখানে সোজাসাপ্টা একটা মাপকাঠি থাকতে হবে। তারা কারা এবং তাদের জন্য কী দরকার। সেটি কীভাবে করতে পারি, সেজন্য চিন্তাভাবনা করে সুপারিশমালা তৈরি করা দরকার।
শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস ও হুমায়ুন কবির