২০৫০ সালের মধ্যে নিট কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বিপর্যয়ের কারণে শুরুতেই ধাক্কা খায় এই উদ্যোগ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে আলোচনা বেড়ে চললেও চলতি বছর নাগাদ ইইউর পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে অঞ্চলটির নিট কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্য অর্জনের পূর্বাভাস হতাশাজনক। এর জবাবে ইউরোপীয় নেতারা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো অগ্রগতি সম্ভব। তবে এর জন্য কার্যকর অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; যা কিনা এখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর ইউরো নিউজ।
২০২০ সালে ‘ইউরোপিয়ান গ্রিন ডিল’ নামের জলবায়ু কর্মসূচি অনুমোদন করে এই জোট। এতে জ্বালানি খাতের বড় ধরনের রূপান্তর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিছু ইইউভুক্ত দেশ এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে পারছে না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার খুবই ব্যয়বহুল। জ্বালানি খাতের রূপান্তরে কারা এ বাড়তি খরচ বহন করবে, তা নিয়ে পক্ষগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ইউরোপিয়ান সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি বোর্ড অন ক্লাইমেট চেঞ্জ গত জুনে জানিয়েছে, ইইউর বর্তমান অগ্রগতি ২০৩০ সালের জ্বালানি ও জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৫০ সালের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ এ লক্ষ্যমাত্রা ধাপে ধাপে অর্জন করা অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কম্পাস লেক্সেকনের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্যাবিয়ান রোক বলেন, ‘ইউরোপে জ্বালানি রূপান্তরের ব্যয় কে বহন করবে, তা নিয়ে একটি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।’
গত সপ্তাহে ব্রাসেলসে ‘বিজনেস ইউরোপ’ শীর্ষক সম্মেলনে ফ্যাবিয়ান রোক বলেন, ‘এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি হ্রাস নীতির (ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মূলত সরকারি অর্থায়নের ওপর নির্ভর করে এ নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে। অর্থাৎ এতে শুধু বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের অর্থ নয়, বরং সব করদাতার অর্থ ব্যয় হচ্ছে। জলবায়ুর টেকসই পরিবর্তনে করের মাধ্যমে অর্থায়ন করা যৌক্তিক। কারণ সবাই এর উপকারভোগী হবে।’
ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ুবিষয়ক রূপান্তরে অর্থায়ন করছে। যেখানে অন্যান্য উদ্যোগের সঙ্গে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ক্ষেত্রে কোম্পানি ও ক্রেতারা অতিরিক্ত পেয়ে থাকেন। অন্য একটি বিকল্প হলো, জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর চাপ তৈরি করা। যারা বেশি জ্বালানি ব্যবহার করবে, তাদের বেশি খরচ করতে হবে। তবে এ পদ্ধতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে চাপে পড়া পরিবারগুলো নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের প্রায় ৩০ শতাংশ সরকারি খাত এবং ৭০ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে আসা দরকার। বিজনেস ইউরোপ সম্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ক্রিশ্চিয়ান এহলার বলেন, ‘জ্বালানি রূপান্তরের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করতে বাজার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান অবস্থায় ইউরোপীয় বাজার এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন করতে পারবে না। ব্যাংকগুলোও অর্থায়নে সক্ষম নয়।’
সমাধান হিসেবে তিনি ক্যাপিটাল মার্কেটস ইউনিয়নের সংস্কারের কথা উল্লেখ করেন। এর লক্ষ্য হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মূলধনের জন্য একক বাজার তৈরি করা।
বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থা দেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করা বেশ জটিল। বিষয়টি লক্ষ করে ক্রিশ্চিয়ান এহলার বলেন, ‘এ রকম বাজারে ১০০ বা ২০০টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা বেশ ব্যয়বহুল। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এর চেয়ে কম ব্যয়ে তা করা যায়। বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোকে এ অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সহায়তা করতে হবে।’
কভিড-পরবর্তী ইইউর ‘রিকভারি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফ্যাসিলিটি’ প্রণোদনার কার্যকারিতার ঘাটতি আছে বলেও উল্লেখ করেন এহলার। তার মতে, অনেক দেশ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ প্রণোদনা ব্যবহার করতে পারছে না।
ইউরোপীয় কমিশনের জ্বালানি বিভাগের কৌশল ও সমন্বয় প্রধান পিয়েরে স্কেলেকেন্সের মতে, ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ইইউর জ্বালানি বাজারগুলো সমন্বয় করা। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো সদস্যরাষ্ট্র অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বাড়তি আর্থিক সহায়তা দেয়, তাহলে এটি অন্য দেশগুলোর জন্য অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারে। এতে পুরো অঞ্চলের জলবায়ু লক্ষ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইউরোপের সব দেশে বিনিয়োগের শর্ত একদম একই রকম হবে না। তবে দেশগুলোর বাজারকে আরো সাদৃশ্যপূর্ণ হতে হবে। ইউরোপের সাম্প্রতিক জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ভর্তুকি দেয়া যুক্তিসংগত।’
ক্রিশ্চিয়ান এহলারের মতে, নিট কার্বন নিঃসরণ কর্মসূচি স্থবির হয়ে পড়লেও একে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে বাজারের বিচ্ছিন্নতার স্বাভাবিকীকরণ ঘটছে। কিন্তু এভাবে জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এ কারণে আরো সমন্বিত পন্থা গ্রহণ করা উচিত।