বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের রফতানি পরিস্থিতি

বাংলাদেশে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কৃষকবান্ধব নীতি প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বৃহৎ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের পর, বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে পুষ্টিনিরাপত্তা এবং খাদ্য রফতানির দিকে গুরুত্ব প্রদান করছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরের

বাংলাদেশে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কৃষকবান্ধব নীতি প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বৃহৎ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের পর, বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে পুষ্টিনিরাপত্তা এবং খাদ্য রফতানির দিকে গুরুত্ব প্রদান করছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরের লক্ষ্যই হচ্ছে কৃষিকে আধুনিকায়ন করে রূপান্তর ও লাভজনক করা। 

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে নানাবিধ কৃষিপণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, উল্লেখযোগ্য কৃষিজাত রফতানি পণ্য হলো পাট ও পাটজাত দ্রব্য, সুগন্ধি চাল, শাকসবজি ও ফলমূল যেমন হিমায়িত আলু, কচু, পটল, মুখীকচু, লাউ, পেঁপে, শিম, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া, আম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, লটকন, আমড়া, পেয়ারা, শুকনা বরই ইত্যাদি। চা, ফুল, নানা রকম মসলা যেমন কালিজিরা, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, শুকনা মরিচ, বিরিয়ানি মসলা, কারি মসলা, তামাক, ড্রিংকস, ড্রাই ফুডস প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ‘ড্রাই ফুড’ বা শুকনো খাদ্য রফতানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এসব ড্রাই ফুডের মধ্যে আছে বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পটেটো ক্র্যাকার ও বাদামের মতো নানান রকম খাদ্যপণ্য। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রফতানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুর জাতীয় শুকনা খাবার, ভোজ্যতেল ও সমজাতীয় পণ্য, ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের মসলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি। গত অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রফতানি ১০০ কোটি ডলারের লক্ষ্য থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এসব পণ্যের রফতানির পরিমাণ ছিল ৯৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। কিন্তু এ রফতানি পরবর্তী নয় মাসে নেমে এসেছে ৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। এ সময়ে কমে গেছে চা, তাজা সবজি, ফুল, ফল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার রফতানি। বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের রফতানির একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সুগন্ধি চাল। কিন্তু এ চালের রফতানি গত জুলাই থেকে পুরোপুরি বন্ধ আছে। স্থানীয় চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার সুগন্ধি চালের রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। রফতানি বন্ধের আগে প্রতি বছর ৯ দশমিক ৫ হাজার থেকে ১০ দশমিক ৫ হাজার টন সুগন্ধি চাল বিশ্বের ১৩৬টি দেশে রফতানি হতো এবং এই বাজার প্রতি বছরই একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। সুগন্ধি চাল রফতানির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে যে বাজার বাংলাদেশ তৈরি করেছিল, সেটা এখন আপাতত তেমন এগোতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই বাংলাদেশের সুগন্ধি চালের বাজার রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শুধু সুগন্ধি চালই নয়, সামগ্রিকভাবে কৃষিপণ্যের রফতানি কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১৬ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের তুলনায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানিতে লক্ষণীয় পতন হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু প্রকৃত রফতানি হয়েছে ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। এ সময় ফল রফতানি কমেছে ৮১ শতাংশ, সবজি ৩৯ শতাংশ, কাট ফ্লাওয়ার কমেছে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শুকনো খাবার রফতানি ১৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। একই সঙ্গে হিমায়িত খাবার প্রায় ১১ শতাংশ এবং চিংড়ির রফতানি ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রফতানির প্রধান গন্তব্য হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চল। এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা হচ্ছেন মূল ভোক্তা। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে শাকসবজি রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও নেপাল। যেসব দেশে ফল রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কাতার, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সৌদি আরব ও অস্ট্রেলিয়া।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ১২ বছর আগেও কৃষিপণ্যের রফতানি আয় ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। গত ছয় বছর খাতটির রফতানি আয় দ্রুত বাড়ছিল। এর মধ্যে শুধু করোনার শুরুতে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রফতানি ৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল, যা পরের বছরই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে চলে আসে। এরপর এ বছরই আবার নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে এ খাতের রফতানি আয়। প্রতিযোগী রফতানিকারক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রফতানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের দাম বেশি হওয়া রফতানি কমার অন্যতম একটি কারণ। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় সবজির মতো কৃষিপণ্যের দাম বাংলাদেশে অনেক বেশি। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দামও বেশি। যে কারণে আটা, ময়দা, তেল, চিনির মতো পণ্যগুলোর মাধ্যমে তৈরি হিমায়িত খাবারের খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে রয়েছে ডলার সংকটে চলতি বছর কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি জটিলতা, ব্যয় বাড়ার মতো সমস্যা। পাশাপাশি বর্তমানে দেশ থেকে সুগন্ধি চালের রফতানি বন্ধ থাকায় সেই বাজার হারানো এবং সুগন্ধি চালের কারণে অন্য পণ্যের রফতানি আদেশ কমে গেছে।

আমদানি-রফতানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণে কৃষিপণ্যের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। বিদেশে বাংলাদেশী কৃষিপণ্যের রয়েছে প্রচুর চাহিদাও। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার ফলে বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। এছাড়া কর রেয়াত ও নগদ সহায়তার মতো সরকারের নীতিসহায়তা কৃষিপণ্য রফতানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশ থেকে যে ১০০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছে, তার মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অংশই বেশি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। আর রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০০টিরও বেশি। বর্তমানে কৃষিপণ্য রফতানি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানিতে কর রেয়াত ও ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। যার ফলে চার বছর ধরে এ খাতে রফতানি আয় বেড়েছে। কৃষিপণ্যের রফতানির বড় অংশ দখল করে আছে প্রাণ গ্রুপ। গত অর্থবছরে তাদের রফতানির পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদিত হয় না এবং তারা মূলত আমদানিনির্ভর। তাই আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা আরো বাড়বে। সে কারণে কৃষিপণ্য রফতানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরো বেশি উৎপাদনমুখী হতে হবে। কিন্তু রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের শুল্ক ও অশুল্ক জটিলতা রয়ে গেছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দূর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া দরকার। 

কৃষিপণ্য রফতানির সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে অন্যতম হলো পণ্য রফতানির জন্য বিমানে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জায়গা না পাওয়া। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যের প্রয়োজনীয় টেস্ট করার জন্য পরীক্ষাগারের অভাব, বিমানবন্দরে হিমাগারের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের কাঙ্ক্ষিত জাতের অভাব, ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি, দুর্বল প্যাকেজিং, সমন্বিতভাবে কাজ না করা ইত্যাদি। কৃষিপণ্য রফতানিতে বাড়তি ফ্রেইট চার্জ, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার অগ্রগতির জন্য একটি বড় বাধা। এর কারণ ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে পণ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় রফতানির বাজারে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যখন সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে তখন ফ্রেইট চার্জ বাড়ানো হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এ চার্জ যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলেও বাংলাদেশে সেটা বেড়েছে। এ কারণে আমাদের পণ্যের খরচ বেশি পড়ছে এবং রফতানি কমছে। ফ্রেইট চার্জের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার কৃষিপণ্য রফতানিতে নগদ প্রণোদনা এবং নীতিগত অগ্রাধিকার প্রদান করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ খাতের পূর্ণ রফতানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না। কৃষিপণ্য রফতানিতে দীর্ঘদিন থেকে একটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে ‘ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন’ সার্টিফিকেট। বাংলাদেশে এ ধরনের সার্টিফিকেট দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সনদ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাছ রফতানিতে মৎস্য অধিদপ্তর, মাংস ও পশুজাত পণ্য রফতানিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। উৎপাদন পর্যায়ে ১৮১টি পণ্যের বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সনদ দেয় বিএসটিআই এবং মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রফতানিতে হালাল সার্টিফিকেট ইস্যু করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত ‘ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন’ সার্টিফিকেট ইস্যুর সক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় রফতানির বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপনসহ মান নির্ধারণী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক ‘হেলথ সার্টিফিকেশন অথরিটি’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে এ জাতীয় সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব হলে রফতানি ১০ গুণ বেড়ে প্রতি বছর ১৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। সঠিকভাবে মান নির্ধারণ ছাড়া রফতানির কারণে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ভারি ধাতুর উপস্থিতি পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, রাশিয়া, চীন আলু, কাঁকড়া ও কুঁচিয়ায় মুরগির বিষ্ঠার উপস্থিতির কারণে সৌদি আরব মিঠা পানির মাছ আমদানি বন্ধ রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা কোনো এক চালানের ফাইটোস্যানিটারি পরীক্ষায় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলার উপস্থিতি পাওয়ার কারণে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৬ মে পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পান রফতানি বন্ধ ছিল। দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে পুনরায় পান রফতানি করতে পারলেও যুক্তরাজ্যে এখনো পান রফতানির অনুমতি পাওয়া যায়নি। অথচ যুক্তরাজ্যেই এ পণ্যের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রফতানি হয়। একইভাবে ফাইটোস্যানিটারি পরীক্ষায় নেতিবাচক ফলাফল পেয়ে রাশিয়ায় আলু রফতানি বন্ধ ছিল প্রায় ছয় বছর, যা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় এ বছরই নতুন করে আবার চালু করা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে ফাইটোস্যানিটারি সনদ ছাড়া কোনো পণ্য রফতানির উদ্দেশ্যে জাহাজীকরণ করা হবে না। তাই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি মন্ত্রণালয় ঢাকার পূর্বাচলে দুই একর জমিতে স্থাপন করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড পরীক্ষাগার। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বহুমুখী প্রচেষ্টায় এ বছর আম রফতানি বেড়েছে। আমের এ বাজার মূলত প্রবাসী বাঙালিকেন্দ্রিক, মূলধারার সুপারশপে আমের সরবরাহ করতে হলে সন্ধানযোগ্যতা থাকা নিশ্চিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে সরকার উত্তম কৃষিচর্চার আওতায় কৃষিপণ্যের সন্ধানযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।

কৃষিপণ্য রফতানি উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় করণীয়গুলোকে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা কৃষিপণ্য রফতানি খাতকে লাভজনক ও আস্থাপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিদেশে শাকসবজি ও ফলমূল রফতানি এবং আলু রফতানির জন্য রোডম্যাপ প্রস্তুত করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উভয় কমিটি কৃষিপণ্য রফতানি বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করেছে। এক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সবজি ফল উৎপাদন, আলুর উন্নত জাতের সরবরাহ বৃদ্ধি, শ্যামপুরে প্যাকেজিং হাউজের কার্যকর ব্যবহার, বিমানে কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে জায়গা বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের জন্য বিমানবন্দরে পৃথক গেট ও স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করা, বিমানবন্দরের হিমাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে আনা, কৃষিপণ্য পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি, পণ্য রফতানির জন্য প্যাকেজিংয়ের মান বৃদ্ধি, বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা বৃদ্ধি, দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন করে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন। ফসল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি কমাতে দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার ব্যবস্থা ও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ দরকার। এছাড়া বৈশ্বিক মান অনুসারে খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্মত পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হলে কঠোর বিধিমালা ও দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর প্রচলিত চেইন শপে কৃষিপণ্য রফতানি করতে হলে পরীক্ষাগারে ফল ও সবজির মান যাচাই করাটা অত্যাবশ্যক। এছাড়া কৃষিপণ্য টাটকা থাকার সময়কাল বাড়াতে হলে অটোমেটিক ওয়াশিং ও ড্রায়িং প্লান্ট, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এবং কুল শকের জন্য কোল্ড রুমের সুবিধাসম্পন্ন অবকাঠামো প্রয়োজন। 

সারা পৃথিবীতে তাজা কৃষিপণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে কিন্তু বাড়ছে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের চাহিদা। উন্নত বিশ্বে এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রেডি টু ইট বা রেডি টু কুক পর্যায়ের খাদ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আমাদের কাছের দেশ ভিয়েতনাম নিজের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এবং আমদানীকৃত কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করে যাচ্ছে। তাদের এ খাতে রফতানি আয়ের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যেখানে আমরা মাত্র ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের কৃষিপণ্য রফতানি করে থাকি। সুতরাং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে এখনই প্রাধান্য দিয়ে উন্নত করতে হবে। এ লক্ষ্যে কৃষিপণ্য থেকে বৈচিত্র্যময় ও চাহিদাসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। বিশ্ব উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। উৎপাদন পর্যায়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে পেঁয়াজ, সবজি ও ধান। একইভাবে আলু ও আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে আমাদের অবস্থান সপ্তম। উৎপাদন ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে এসব পণ্য থেকে প্রক্রিয়াজাত পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। নির্দিষ্ট ও গতানুগতিক কিছু পণ্যের মধ্যে রফতানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় পণ্য রফতানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের রফতানি বাণিজ্য চালু রয়েছে তার বাইরে আরো নতুন দেশে বাজার খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তা জানতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলো উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারিভাবে যোগাযোগ করতে হবে। অন্যদিকে রফতানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে হলে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশী বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্পপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্র্যান্ড যেমন প্রাণ, স্কয়ার ইত্যাদির প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় বর্তমানে এ খাতের বাজার বিস্তৃতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশের রফতানি নীতি ২০২১-২৪-এ কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারের জন্য অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিল্পনীতি ২০২২-এ এই খাতকে রফতানি বহুমুখীকরণের অন্যতম খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।  এছাড়া বর্তমান সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২৫-এ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কৌশল বাস্তবায়নের জন্য বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে। বর্তমানে সরকারের নানান ধরনের নীতি সহায়তা যেমন ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা, স্থানীয় বিনিয়োগে কর ছাড়ের সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সমর্থন থাকার পরেও রফতানি বাজার সম্প্রসারণে অগ্রগতি সাধন হচ্ছে না। ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ হলে এ খাত সরকারের নগদ প্রণোদনা ও বিভিন্ন দেশের দেয়া রফতানি সুবিধাগুলো হারাবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। এ বাস্তবতায় আধুনিক পরীক্ষাগারে খাদ্যমান নিশ্চিত করা, বিশেষায়িত হিমাগার ও মোড়কজাত করার অবকাঠামোর ঘাটতি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে অপর্যাপ্ত গবেষণা ও বাজারজাতে আধুনিক প্রযুক্তির অভাবের মতো সমস্যার সমাধান না করা গেলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর নগদ প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বন্ধ হলে এ খাতের রফতানি হুমকির মুখে পড়বে।

লেখক: অধ্যাপক, কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

[email protected]

আরও