বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর। সুয্যিমামা এরই মধ্যে তার তেজ জানান দিয়ে চলেছে। হাতিরঝিল থেকে মেরুল বাড্ডার গা ঘেঁষে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনে। গন্তব্য ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস। হাতিরঝিল পেরিয়ে মূল রাস্তায় আসতেই বোঝা গেল গন্তব্য একেবারেই কাছে। অনেকটা দূর থেকেই অনিন্দ্যসুন্দর এ ভবন দেখা যায়। মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটা করিডোর। কংক্রিটে তৈরি বসার জায়গাগুলোয় শিক্ষার্থীরা কেউবা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছেন, কেউবা সহপাঠীর সঙ্গে মেতেছেন খোশগল্পে। আর একটু সামনে যেতেই দেখা গেল শিক্ষার্থীদের জটলা। এস্কেলেটর বেয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বড় এ এস্কেলেটর বেয়ে একেবারে চারতলায় ওঠা যায়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরাও এ এস্কেলেটর দিয়ে উঠে পড়লাম চতুর্থ তলায়। উঠতে উঠতে এস্কেলেটরে শিক্ষার্থীদের ভিড় আর চারপাশের চাকচিক্য দেখে এক মুহূর্তের জন্য শপিং মলের কথা মনে পড়ল। ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গরম ভাবটা একেবারে উবে গেল। বেশ সুশীতল একটা অনুভূতি হচ্ছে এখন। চারপাশের আবহ জানান দিলে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে তাপমাত্রার পার্থক্য।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন এ ক্যাম্পাস চোখ ধাঁধানো। দেশের প্রথম টেকসই ইনার সিটি ক্যাম্পাস। চারদিকে সবকিছু একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে-তকতকে। মাস তিনেক হলো নতুন এ ভবনে কার্যক্রম শুরু করেছে ইউনিভার্সিটি। মাহে রমজানের কারণে ক্যাফেটেরিয়াটা কিছুটা শান্ত। বসার জায়গাগুলোয় কেউবা ল্যাপটপে মগ্ন। কেউ ব্যস্ত মোবাইলে। ক্যাফেটেরিয়া পার হয়ে এবার আমরা চললাম ক্যাম্পাসের অন্য জায়গাগুলো দেখার উদ্দেশ্যে। কী নেই ক্যাম্পাসে! আধুনিক স্থাপত্য ও পরিবেশ সচেতনতার এক নিবিড় মেলবন্ধনের ছাপ রয়েছে ভবনের প্রতিটি পরতে পরতে। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে। ক্যাম্পাসের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ শতাংশ জলাধার, লেক ও জীববৈচিত্র্যের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
নিচতলার প্রায় পুরোটা উন্মুক্ত। রয়েছে একটি মাল্টিপারপাস হল এবং অডিটোরিয়াম। একটি লেক নির্মাণের কাজ শেষ, এখন তাতে শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ চলছে। রয়েছে অসংখ্য গাছপালা। দ্বিতীয় তলায় আধুনিক মেডিকেল সেন্টার, এক্সিবিশন গ্যালারি। তৃতীয় তলায় বেশকিছু দপ্তরসহ রয়েছে একটি ডে কেয়ার সেন্টার। আদর নামে এই ডে কেয়ার সেন্টারটিতে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত শিক্ষক-কর্মীদের সন্তানদের দেখভাল করা হয়।
চতুর্থ তলার অর্ধেকটায় ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্টার দপ্তরসহ বিভিন্ন অফিস। ষষ্ঠ তলার পুরোটা জুড়েই ক্যাফেটেরিয়া, স্টুডেন্ট লাউঞ্জ, অ্যালামনাই রিলেশন্স, ক্লাব কিউবিকলস এবং ডিসকাশন রুম রাখা হয়েছে। এসব মুক্ত জায়গাগুলোয় শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছেন বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে। ক্লাবের কিউবিকলগুলোয় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছেন। ভবনের সপ্তম তলা থেকে দ্বাদশ তলা পর্যন্ত পুরোটাই ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি। নিমেষেই বোঝা সম্ভব যে সবচেয়ে আধুনিক ও বহুল সুবিধাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এটি। অষ্টম-নবম তলা পুরোটাই লাইব্রেরি। দারুণ পড়াশোনার পরিবেশ। একা, দুজনে কিংবা দলবেঁধে গ্রুপ স্টাডির জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কুঠুরির মতো ব্যবস্থা। রয়েছে আলাদা ডিসকাশন রুম। লাইব্রেরির এ অষ্টম-নবম তলা সংযুক্ত করেছে প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে পড়ায় একঘেয়েমি কাটাতে যেন এ ওপেন স্পেসে এসে একটু গল্পগুজবও করা যায়। অবশ্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিঃশব্দে গল্পরত চোখেও পড়ল।
ভবনের কারিগরি দিকটা সবাইকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। ক্রস ভেন্টিলেশন এবং হাইব্রিড থার্মাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় ভবনটির সবদিক থেকেই আলো ও বাতাস প্রবেশ করতে পারে। অ্যারো ডায়নামিক ফিন ভবনের ভেতরে বাতাসের সর্বোচ্চ প্রবাহ নিশ্চিত করবে। ভবনের গায়ে সবুজ চাদরের মতো লেগে থাকা গাছগুলো অক্সিজেন সরবরাহ করবে এবং হাইব্রিড কুলিং সিস্টেম ক্লাসের ভেতরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে আসবে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাসে বসে থাকলেও তাদের ক্লান্তি আসবে না। এসবের ফলে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের নির্ভরতা কমে আসবে। যা সাশ্রয় করবে এ ভবনের ৪০ শতাংশ এনার্জি। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। যেখানে একটি স্বচ্ছ জলাধারের ওপর একাডেমিয়ার কার্যক্রম চলবে। বৃষ্টির পানি জলাধার পর্যন্ত যাতে পৌঁছতে পারে সেজন্য অসংখ্য রেইন চেইন বসানো হয়েছে। এ পানি দিয়েই ভবনের গাছপালাগুলোয় সেচ প্রদান করা হবে এবং বাড়তি পানি জলাধার পূরণে কাজে লাগবে। এ ভবনে রয়েছে অ্যাডভান্সড সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। এ প্লান্টেই হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ভবনের ছাদে রয়েছে ১ দশমিক ৪ মেগাওয়াট পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তিসম্পন্ন সোলার প্যানেল, যা ভবনের প্রয়োজনীয় শক্তির ২৫ শতাংশ। অত্যাধুনিক ও নান্দনিক এ ভবনের বেশির ভাগ জায়গা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এসব উন্মুক্ত জায়গায় তারা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এবং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ করতে পারবেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা যেন সহজে ক্যাম্পাসে আসতে পারে এবং সব জায়গায় বিচরণ করতে পারে, সেজন্য রয়েছে ইউনিভার্সাল অ্যাকসেসিবিলিটি।
এ ভবনের ছাদটাকে আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেই না। রয়েছে সবুজ ও বিশালাকার একটা খেলার মাঠ। বাংলাদেশের আর কোথাও ছাদে খেলার মাঠ আছে বলে আমার মনে পড়ল না। এ ছাদ থেকে ঢাকার সৌন্দর্য অবাক করার মতো। হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে অন্তত একবার এ ছাদে অবশ্যই আসা উচিত। নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে কথা হলো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ইইই বিভাগের ইমাম-উর-রশিদ বলেন, ‘নতুন ক্যাম্পাস আসলেই স্বপ্নের মতো। ভালো লাগছে ক্যাম্পাসটি পেয়ে। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো ওপেন স্পেসগুলো। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে এসে যেন মনে হয় যান্ত্রিক ধুলোমাখা ব্যস্ত ঢাকাকে পেছনে ফেলে এক নির্মল সুন্দর পরিবেশে চলে এসেছি।’ সিএসই বিভাগের ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘ক্যাম্পাসের স্থাপত্যশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রশস্ত শ্রেণীকক্ষ, অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, সত্যিই লেখাপড়ার জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ।’
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। ক্লাস শেষে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন। এবার আমাদেরও ফেরার পালা। মেরুল বাড্ডার মোড় পার হয়ে আমরাও ছুটে চললাম হাতিরঝিলের পথ ধরে। অনেক দূর থেকেও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নবনির্মিত ভবনটি দেখা যাচ্ছে। দূরদৃষ্টিতে চোখের একটি পলকেই যেন জানান দিচ্ছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ভবনটি ঢাকার এ অংশের নান্দনিকতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।