মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়াতে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। নানা আয়োজনে বাংলাদেশেও পালিত হয় দিনটি। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৯৮ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মাসে গড়ে ৪২ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। তবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরি করা আজও সম্ভব হয়নি। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের মতামত তুলে ধরেছেন ফাইয়াজ মুহাম্মদ কৌশিক
মানসিক যন্ত্রণা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে
নাজরিল ইহসান রাহীম
শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শিক্ষার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপে পড়েন, যা তাদের হতাশা, উদ্বেগের চরম অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারা, বন্ধুহীনতা বা পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে একাকিত্বের অনুভূতি শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক চাপে অনেকে হতাশ হয়। অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিবারের উচ্চ প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে হতাশায় ভোগেন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা কিংবা প্রেমে ব্যর্থতাও অনেকের মানসিক যন্ত্রণা বাড়াতে পারে, যা তাকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এ ধরনের মানসিক অবস্থা তাদের উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চায়, গবেষণায় ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
হতাশা থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ান অনেকেই
মাহিদুল ইসলাম আকিব
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মূলত পারিবারিক চাপ, বেকারত্ব, নতুন পরিবেশে না মানাতে পারা, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে এবং বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাদক গ্রহণ, ছিনতাই, অরাজকতা।
অনেক শিক্ষার্থী মানসিক হতাশা থেকে বাঁচতে মাদক গ্রহণ করে। এতে তারা সাময়িকভাবে নিজেকে হতাশামুক্ত মনে করলেও দীর্ঘমেয়াদি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় এবং তারা এ মাদকের চক্র থেকে আর বের হতে পারে না। এভাবে একটা তাজা প্রাণ বিলীন হয়ে যায় মাদকের অতল গভীরে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন এসবে জড়িয়ে পড়তে না পারেন সেজন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা জরুরি।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র
আব্দুল্লাহ আল মামুন
শিক্ষার্থী, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মনস্তত্ত্ব বা মানসিক স্বাস্থ্য। আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেটা অনেকাংশে কমে আসে। ফলে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে। এ সময় তারা যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাববোধ করেন এবং যেকোনো ভুল সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকেই দায়ী করেন। তৈরি হয় হতাশা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, বাড়ে অপরাধপ্রবণতা। পাশাপাশি একাডেমিক পড়াশোনার ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এ সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র, মাসিক/ত্রৈমাসিক/বার্ষিক কাউন্সেলিং, বিভিন্ন অপরাধবিরোধী ক্যাম্পেইন ও প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্ট আয়োজন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আমার ধারণা।
জ্ঞানচর্চায় এর গুরুত্ব অপরিসীম
সুরাইয়া পারভীন প্রান্তিকা
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে একজন শিক্ষার্থী শুধু পড়াশোনায় নয়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও সফল হতে পারে। যদি একটু বিশ্লেষণ করে বলি, মানসিক সুস্থতা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে এবং পড়াশোনায় উন্নতি করতে সহায়তা করে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীরা সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ও নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। সুতরাং মানসিকভাবে সুস্থ থাকা একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একাডেমিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখে
জান্নাতুল ফেরদৌস মোহনা
শিক্ষার্থী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা একাডেমিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। উচ্চ শিক্ষার সময় শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের চাপ যেমন পরীক্ষার চাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্বেগের মুখোমুখি হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে হতাশা, উদ্বেগ এমনকি ডিপ্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সুস্থ মানসিক অবস্থা শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলতে সহায়ক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবুজায়িত ক্যাম্পাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ গাছপালা এবং খোলা পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমিয়ে মনকে সতেজ করে এবং পড়াশোনায় মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সেলিং এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যেন মানসিক চাপ সামলাতে পারে এবং একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে।