শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য

উন্নত বিশ্বে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে

এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মন খারাপ হবেই। ঋতু পরিবর্তন কিংবা হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো বোঝা যায় না যে কেন মন খারাপ লাগছে।

ফায়েজা আহমেদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়সহ এ বিষয়ের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুর রহমান

কোনো শিক্ষার্থী যদি হতাশা কিংবা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তার মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাথমিকভাবে করণীয় কী কী?

এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মন খারাপ হবেই। ঋতু পরিবর্তন কিংবা হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো বোঝা যায় না যে কেন মন খারাপ লাগছে। মন খারাপ এবং হতাশার মধ্যে পার্থক্য আছে। অবসাদ বা হতাশা দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। হয়তো সকালে উঠতে তার অসুবিধা হয়। দৈনন্দিন কাজগুলো করতে বেশ কষ্ট করতে হয়। এ অবস্থার মধ্যে যদি কাউকে দেখা যায় সেক্ষেত্রে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে। পেশাগত সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হয়ে সাইকোথেরাপি নেয়া যেতে পারে। আবার কখনো কখনো সাইকোথেরাপির মাধ্যমে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব না। সেক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ যারা আসলে ওষুধ দিয়ে থাকেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক কিংবা সহপাঠীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

নবাগত শিক্ষার্থীরা প্রথমত একটি প্রতিষ্ঠানেই আসে। শুরুতেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের মাধ্যমে কারিকুলাম ও রীতিনীতি বুঝিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে যে কেউ যদি মানসিকভাবে কষ্টে থাকে, অবসাদগ্রস্ত হয়, আত্মহত্যাপ্রবণতা দেখা যায় কিংবা পারিবারিক কোনো জটিলতা দেখা যায় তাহলে যেন শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারদের সঙ্গে এসে কথা বলে। আবার সহপাঠীরা একই বয়সের হওয়ায় তাদেরই জানা নেই যে মানসিক সাপোর্ট কীভাবে দেবে। উল্টো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে সহপাঠীকে বিশ্বাস করে কোনো বিষয় শেয়ার করায় সে তা ফাঁস করে দিয়েছে। পরে তা আরো বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সহপাঠী ওই বন্ধু গোপনীয়তা বজায় রাখতে নাও পারে। তাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে সহপাঠীদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানো যেতে পারে। কিন্তু কিছু শেয়ার না করাই ভালো। তবে যে খুব কাছের ও বিশ্বাসযোগ্য কাউকে শেয়ার করা যেতেও পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন এ জায়গায় আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কেননা কভিড-পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়েছে। হতাশাসহ বিভিন্ন মানসিক জটিলতা বেড়েছে। সুতরাং তাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে মানসিক সেবাদান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ করতে হবে।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য কী করতে পারে?

দুটি বিষয় জড়িত। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলে করণীয়; দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর করণীয়। শিক্ষার্থীর করণীয় আসলে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আমাদের যে শারীরিক হরমোন আছে সেগুলো বিভিন্ন কারণে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তখন দেখা যায়, সুস্থ মানুষ হঠাৎ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে অসম্ভব রকমের অস্থিরতা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে হেলদি রুটিন বজায় রেখে চলতে হবে।

পুষ্টিকর খাবারের একটি ভূমিকা আছে। এ খাবার একজন মানুষের মন ও দৈহিক সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে খুবই জরুরি। অনেক শিক্ষার্থী রাত জেগে থাকে, অনেক বেলা করে ঘুমায়। সকালে নাশতাও করে না। অনিয়মিত, ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড ও বাইরের খাবার খায়। এটা মনোদৈহিক সাম্যাবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে। আরেকটি বিষয় হলো শারীরিক পরিশ্রম কম হওয়া। খেলাধুলার মতো শারীরিক কাজে ব্যস্ত না থেকে লম্বা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকে। ফলে কায়িক পরিশ্রম কম হয়। তাই ঘুম কম হওয়াসহ নানা রকমের জটিলতা বেড়ে যায়। ডিভাইস ব্যবহারের সময় কমিয়ে আনতে হবে। তাই হেলদি রুটিন, ডায়েট খাবার, শারীরিক কসরত যদি নিয়মিত করতে পারে তাহলে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে এবং মানসিক সমস্যা অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে পারে।

যাদের খুব দ্রুত মুড সুইং হয় তাদের করণীয় কী?

মুড সুইংয়ের বিষয়টি মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। হরমোনাল চেঞ্জের কারণে ছেলেদের ক্ষেত্রেও মুড সুইংয়ের ব্যাপারটি হয়। একবার কিংবা দুবার হলে ঠিক আছে কিন্তু এটা নিয়মিত হলে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে। এ রকম কোনো কিছু দেখা গেলে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং বিষয়টি সমাধানে কাজ করতে হবে। আবার কারো যদি বিশেষ সময়গুলোয় মুড সুইং হয় তাহলে নিজেকে নিজের মনিটরিং করতে হবে। নিজেকেই নিজে কোচ করা। এ সময় যেহেতু আমার মুড সুইং হয় এবং মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার হয় সেহেতু এ সময়ে সবার সঙ্গে কম যোগাযোগ করা কিংবা নিজেকে সংযত রাখা।

শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক মনঃস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কেন জরুরি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেহেতু পরিবার থেকে দূরে থাকছে সেহেতু তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দেয়া দরকার। যদি না দেয়া হয় তাহলে এ জায়গায় ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে ওই শিক্ষার্থীদের যে ক্যাপাসিটি ছিল তা পুরোপুরি ব্যবহার করতে অসমর্থ হবে। তার সম্ভাবনা কাজে লাগবে না। এই মানসিক জটিলতা এমন একটি বাধার সৃষ্টি করবে যে সে আর সামনে এগোতে পারবে না। একটি প্রতিষ্ঠান চায় এর আওতায় আসা শিক্ষার্থীরা যেন সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছায়। তাই যদি টার্গেট পূরণ করতে চায় তাহলে একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখে। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানে যখন একটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতামূলক অনেক সেমিনার ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক ওয়ান টু ওয়ান সেবা নিশ্চিত হয়। এ সময় মানসিক সুস্থ থাকার জন্য অনেক কৌশল শেখা যায়। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা সুস্থ জীবনের দিশা পায়। সুতরাং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা দুই-ই নিশ্চিত হবে। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কিন্তু এমন ব্যবস্থা রয়েছে।

আরও