গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাকিল হোসেন জুলফিকার। ৭ আগস্ট আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে বেলা সাড়ে ৩টায় মারা যান তিনি। ঘটনার দিন মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে বেলা ১টার দিকে মাথায় দুটো গুলি লাগে তার। শাকিলের মা বিবি আয়েশা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘৪ তারিখ দুপুর ১২টার দিকে বাসায় আসে শাকিল। খাবার খেয়ে আবার সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে যায়। বিকালে কয়েকজন ছাত্রী এসে বলে আন্টি শাকিল একটু অসুস্থ কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়া হইছে। আপনি না গেলে ডাক্তার চিকিৎসা করবে না। এরপর একটা সিএনজি নিয়ে বের হলে পথে অনেক বাধার মুখে পড়ি। ওখানে যাওয়ার আগেই শুনি নিউরোসায়েন্সে নেয়া হচ্ছে। সেখানে গিয়া দেখি আমার বাবার কোনো সাড়াশব্দ নাই। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। এ অবস্থায় ক’দিন হাসপাতালেই ছিল। ৭ আগস্ট ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।’
নদী ভাঙনে বাপ-দাদার স্থায়ী ঠিকানা হারিয়ে শাকিলের পরিবারের নতুন আবাস ছিল নানা বাড়ি। ভোলা সদরের বাঘমারা চরের ৩ নং ওয়ার্ডই তার স্থায়ী ঠিকানা। বাবা সিদ্দিক মৃধা পেশায় ছিলেন জেলে। ভোলার মেঘনা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০১৪ সালে খাদ্যনালি শুকিয়ে ছয় মাস শয্যাশায়ী থাকার পর মারা যান শাকিলের বাবা। তার মৃত্যুর পর বড় দুই বোন, শাকিল আর ছোট আরেক ভাইকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ঢাকার মিরপুরে আসেন শাকিলের মা বিবি আয়েশা। দুই বোন কাজ করতেন গার্মেন্টসে। আর মা মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। দুই বোনের বিয়ের পর শাকিলের ছোট এক ভাই আর মা বিবি আয়েশাকে নিয়েই তার পরিবার। ছোট ভাই ১৭ বছর বয়সী সুমন এক পাঞ্জাবির কারখানায় কাজ করেন।
ঢাকায় আসার পর শাকিলের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় ব্র্যাকের স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন মিরপুর-১২ নম্বরে অবস্থিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল ‘আমাদের পাঠশালা’য়, এরপর পল্লবীর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ ও হারুন মোল্লা ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনা শেষে চারুকলায় উচ্চ শিক্ষার পাঠ নিতে ভর্তি হন বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে (ইউডা)। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি মিরপুরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিদ্যায়তন ‘আমাদের পাঠশালা’র হিসাব সহকারীর দায়িত্ব পালন করতেন। আর টিউশনি করে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেন। আমাদের পাঠশালার প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৪ সালে যখন এখানে ভর্তি হয় সে সময় থেকেই শাকিলকে চিনি। সবসময় টানাপড়েন ছিল তাদের সংসারে। পড়াশোনার পাশাপাশি রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করা, ভ্যানগাড়ি চালানোসহ নানা কাজ করত শাকিল। যখন আমরা দেখলাম শাকিল বেশি পরিশ্রম করার জন্য অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ওর পড়াশোনার দায়িত্ব আমরা নিই। বছর দুই ধরে শাকিল পরিবারের হাল ধরেছে। ছোট ভাই এক কারখানায় কাজ করে। শাকিলের মৃত্যুতে পরিবারের হাল ধরার মতো সামর্থ্যবান আর কেউ থাকল না।’