রিকশাচালক আলেক চান। গ্রামের বাড়ি উত্তরের জেলা সিরাজগঞ্জে। থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রিকশা চালান দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে। ক্যাম্পাসের অনেক ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়াল লিখনগুলো নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে দেওয়ালে শুধু একই রকমের কতা আছিল। একই রং, একই লেহা। কিন্তু এহুন বিভিন্ন রহমের লেহা দেহি, বিভিন্ন রহমের ছবি। পড়াশোনা করি নাই। লেহাপড়া পারি ন্যা। তয় ছবি দেইখ্যা বুঝি মামারা (শিক্ষার্থী) কী লেকছে। পুরো ভার্সিটির প্রত্যেক দেওয়ালই এহুন নানা রঙে সাজানো। আগের চাইতে মেলা ভাল্লাগে।’
কথা বলতে বলতে শার্টের পকেট থেকে বাটন মোবাইল ফোনটি বের করেন। মোবাইলের ওয়াল পেপার রোকেয়া হলের সামনে আঁকানো একটি গ্রাফিতি দেয়া রয়েছে। ওই গ্রাফিতিতে একজন পুলিশ সদস্য আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থীর মুখ চেপে ধরা ছিল। ওয়াল পেপার দেখিয়ে আলেক চান বলেন, ‘পড়া পারি ন্যা। তয় এই রহমের মেলা ছবি দেইখ্যাই বুঝতে পারছি, মামাদের (শিক্ষার্থী) সাথে পুলিশ কী করছে। এগুলার বিচার ওইব না?’ পরে আলেক চানের রিকশায় পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দ্রোহ, দেশপ্রেম, সাম্য, শোক ও ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তা। রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের ইঙ্গিতও রয়েছে কোনো কোনো গ্রাফিতিতে। পথে যেতে বুদ্ধিদীপ্ত আর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এসব সৃষ্টিশীল কাজ দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছে নগরবাসী। কেউ কেউ দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। সেগুলো আবার ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারও করছেন।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার তুমুল প্রতিবাদের জেরে শেখ হাসিনার পলায়নের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থক শিক্ষার্থীরা এসব এঁকেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সামষ্টিক কিংবা একক অর্থায়নে রঙ, তুলি কিনে চিত্রগুলো অঙ্কন করা হয়। এ কাজে যুক্ত হন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়ালে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের দলীয় লেখা ও লোগো শোভা পেত। সে সব মুছে ফেলেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, শুধু একমত ও পথের নয়, সবার কথা লেখা থাকবে দেয়ালে। মানুষ তার বিবেচনা দিয়ে যা ভালো মনে করবে তাই গ্রহণ করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বর্তমান যে দেয়ালিকাগুলো দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান প্রজন্মের হাতে লেখাগুলো অবশ্যই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভাবিয়ে তুলবে। তাই আমি ভবিষ্যতে এমন সবকিছুর সংমিশ্রণে দেয়ালিকা দেখতে চাই। একচ্ছত্র কোনো দলের দেয়ালিকা দিয়ে সব ভরে যাক এটা দেখতে চাই না। সবার কথা থাকুক, সবাই কথা বলুক। তবেই প্রকৃত স্বাধীনতা মিলবে।’