বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুর দিকে আবাসিক চরিত্র ঠিক থাকলেও সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রশাসনের নির্বিকার অবস্থানের জন্য নিয়মিত আবাসনের বাইরে গড়ে ওঠে ‘গণরুম’। গণরুম মানে প্রতিটি সিটের বিপরীতে একজন শিক্ষার্থীর আবাসিকতা নয়। কখনো প্রতিটি সিটের বিপরীতে দুই-তিনজন শিক্ষার্থী কখনোবা টেলিভিশন কক্ষ, ডাইনিং কক্ষে একসঙ্গে ৫০-১০০ জন শিক্ষার্থী অবস্থান করতেন। এদের সবাইকে থাকতে হতো মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে। গণরুমের নিয়ন্ত্রণ থেকে আবাসিক হলের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের হাতে। গণরুমে ছিলেন এমন শিক্ষার্থীদের কেউ এটাকে বলছেন ‘রাজনৈতিক টর্চার সেল’ আর কেউ একে বলেছেন ‘স্বপ্নের শ্মশান’। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের প্রভাবে এতদিন বিষয়গুলো নিয়ে চুপ ছিলেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই।
টর্চার সেল বলতে ভেসে ওঠে কোনো পরাধীন জনভূমি বা কোনো অত্যাচারী গুণ্ডা বাহিনীর কথা আর শ্মশান মানেই মরদেহ দাহ করার স্থান। কিন্তু কেন তারা আবাসিক হলের কোনো স্থানকে এমন নামে অভিহিত করেছেন তা ব্যাখ্যা করেছেন তারা। অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্যে রয়েছে কান ধরে উঠবস করানো থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত, বাবা-মাকে গালাগাল করা থেকে পর্ন নায়িকার অভিনয় এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের কায়দা-কানুনও শেখানো হতো গণরুমে। গণরুমের বিষয়বস্তু চর্চার জন্য নিয়মিত সহযোগী ছিল আবাসিক হলের অতিথি কক্ষ বা গেস্টরুম। কখনো তুলনামূলক কম অত্যাচারকে বলা হতো ‘ফাঁপর’। ফাঁপর কিংবা নির্যাতনও হতো গেস্টরুমে।
গণরুম বা গেস্টরুম একাধারে ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কর্মী তৈরি ও বিরোধী মত দমনের কেন্দ্র। এসব জায়গায় প্রভোস্ট ও প্রক্টরের আসা ‘নিষেধ’ ছিল। ২০১৯ সালে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যু হলে সারা দেশে প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গণরুম-গেস্টরুমে নিপীড়নের মাত্রা কমতে থাকে জাবিতেও। তবে প্রাণে না মারলেও গণরুম ছিল স্লো-পয়জনিংয়ের মতো। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর তার লালিত স্বপ্নের মৃত্যু হতো, কিন্তু তিনি থাকতেন অসহায়। জেনেশুনে এ মৃত্যুকে মেনে নিতেন অনেকেই। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হলে এর মাত্রা ছিল তুলনামূলক কম। এ নিপীড়নের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীকেই ক্লাস, পরীক্ষা বাদ দিতে হতো। ভয়ের এ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় নবীনদের মা-বাবার স্বপ্ন বিনষ্ট হতো অঙ্কুরেই। পরীক্ষার ফলাফলে প্রকাশিত হতো বাস্তব চিত্র। প্রথম বর্ষে মেধার লড়াইয়ে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী শেষ বর্ষে ফিরতেন করুণ শরীর নিয়ে।
এক ছাত্রকে হলের ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছিল ছাত্রনেতাদের ‘অবাধ্য’ হওয়ায়। গত বছর নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি আবাসিক হলের চারটি চালু হওয়া এবং গত ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করার পর স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এসেছে। চুল বড় রাখা, ছাত্রনেতাদের সালাম না দেয়া, এমন সব ঠুনকো অজুহাতে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বহু নেতার বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী মমতাজ বেগম অন্তরাকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব দেখিয়ে টর্চার করার অভিযোগ ওঠে বিভাগটির দ্বিতীয় বর্ষের সাবরিনা আক্তার মিতু, রাজিয়া ও সামি রেজওয়ানা নামে তিন ছাত্রীর বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে প্রথম বর্ষের রাকিব নামে এক নবীন ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতন করেন রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে সিএসই বিভাগের মিজানুর রহমান নামে আরেক নবীন শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে হেনস্তা করা হয়। এতে ওই শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পরের বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আলমকে থাপ্পড় দিয়ে কান ফাটিয়ে দেন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী শিহাব। এছাড়া সেদিন র্যাগিংয়ের হুমকি দেয়ায় হল ছেড়ে এক রাত খোলা আকাশের নিচে কাটান হলটির নবীন শিক্ষার্থীরা। এ সময়ে বহুবার একাধিক সিন্ডিকেটের বৈঠকে র্যাগিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। র্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুযায়ী আজীবন বহিষ্কার, অভিযুক্তকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার বিধানসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত পাস হলেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে তার শাস্তি ছিল সাময়িক বহিষ্কার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী উৎপল বলেন, ‘সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও প্রথম বর্ষ থেকেই আমি বাইরে থেকেছি। আমি স্বেচ্ছায় বাইরে থাকিনি, আমাকে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সিনিয়র ব্যাচ কর্তৃক আমি প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতাম। আমাকে গণরুমে পর্ন ভিডিওর মতো অভিনয় করে দেখাতে বলা হয়।’ অর্থনীতি বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের মাহমুদ আরিফ ও দর্শন বিভাগের মাহম্মুদুল হক পর্ন তারকা মিয়া খলিফার মতো চরিত্রে সাজানোর জন্য বুকে গামছা দিয়ে মেয়েলি শারীরিক অবয়ব করতে জোর করে। সেদিন আমার সঙ্গে যা হয়েছিল, তা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের একটি কালো রাত হিসেবে স্মৃতিতে আঁচড় কেটে থাকবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম ব্যাচের বাংলা বিভাগের তন্ময় মন্ডল বলেন, ‘প্রথম বর্ষে ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে সালাম দেয়া নিয়ে আমাকে চরম গালিগালাজ করা হয়। এ ঘটনায় আমার কানে জোরে একটা থাপ্পড়ও দেন তিনি। সে মুহূর্তে মনে হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা অর্থহীন। আবার এ ঘটনা কাউকে না বলতে আমাকে হুমকিও দেয়া হয়েছিল।’
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী তানভীর রিফাত অনিক জানান, গণরুমে অত্যাচার ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। বড় ভাইদের পছন্দমতো কিছু না হলেই বলা হতো ‘হ্যাডম’। অপমান, গালাগালের সঙ্গে মারধর। এসব নিয়ে এক পর্যায়ে হলে আর থাকেননি তিনি।