বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া শত শত শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্যতম একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন যেন ভুলতে পারছেন না তাকে। বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকরাও ভুলতে পারছেন না ক্যাম্পাসে কাটানো তার স্মৃতিমাখা দিন। তরুয়ার বাবা রতন তরুয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি, মা অর্চনা রানী হার্টের রোগী হয়েও বাসাবাড়িতে কাজ করেন। বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। পটুয়াখালীর সদরে নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া থাকে তরুয়ার পরিবার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবা-মার নিজেদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় এ দম্পতি মানুষ করতে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন তরুয়া। চারদিন আইসিইউতে থাকার পর গত ২৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলিতে হৃদয়ের ফুসফুস ফুটো হয়ে গিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন দুজন। একজন পটুয়াখালীর হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, অন্যজন মাগুরা জেলার ফরহাদ হোসেন। এ দুজনই চবির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করা চবি শিক্ষার্থী রিয়াদ উদ্দিন বলেন, ‘একটা মানুষ কীভাবে জীবন বাজি রেখে নিজেদের ও দেশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে জীবন দিতে পারে তা তরুয়াকে দেখে বুঝতে পেরেছি। তরুয়া নাই তাকে যেন এক মুহূর্তের জন্যও অনুপস্থিত মনে হয় না। সে আমাদের সবার মনে জায়গা করে নিয়েছে। ছিল আমাদের সহযোদ্ধা। আমরা কখনো তাকে ভুলব না।’
বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষকদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি আন্দোলনকারী সহপাঠী শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেছেন তরুয়াকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামনের পিলারে বড় অক্ষরে লিখে রাখা হয়েছে, ‘হৃদয়ে তরুয়া তরুয়া হৃদয়’। তরুয়ার আবাসিক হলের সামনের দেয়ালে স্থান পেয়েছে তার গ্রাফিতি। বন্ধুদের ভাষায় বিপ্লব আর তারুণ্যের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন শহীদ তরুয়া।
তরুয়া সম্পর্কে তার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সালমা বিনতে শফিক বলেন, ‘প্রথম দিনেই চোখে পড়ে আলাদা করে। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা ছড়ায়। তরুয়া নামের অর্থ জানতে চাই উপস্থিতির খাতায় নাম ডাকার সময়। পূর্বপুরুষ কাঠমিস্ত্রি, তরুয়া তাদের বংশীয় পদবি। কী অকপট স্বীকারোক্তি! দারিদ্র্য কিংবা গ্রাম্যতা লুকানোর কোনো চেষ্টা নেই ওর মধ্যে। ওকে যে ভালোবেসে ফেলি তা নয়, শ্রদ্ধাও করতে শুরু করি। প্রথম দিন থেকেই নিয়মিত ছাত্র, মনোযোগী শিক্ষার্থী। উপস্থিতির নম্বরের জন্যই শুধু সশরীরে শ্রেণীকক্ষে আসে না সে। অদম্য তার জানার আগ্রহ। প্রশ্ন করতে ভালোবাসে, প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক প্রশ্ন। অনুসন্ধিৎসু এ যুবকের প্রতিটি প্রশ্নই আমাকে ভাবায়। ফরাসি বিপ্লবের বহুমাত্রিকতা, বারবার মুখ থুবড়ে পড়া, বিপ্লবের বরপুত্র নেপোলিয়নের হাতে বিপ্লবের কবর রচনা ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সবকিছু নিয়েই তার প্রশ্ন, নিদেনপক্ষে বিচক্ষণ অভিমত। ফরাসি বিপ্লব তো শত শত বছরের সামন্ততান্ত্রিকতা, রাজতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থসামাজিক বৈষম্য, বিচারহীনতাসহ অনেক অব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিল, তবু কেন চার দশকের মাথায় জুলাই বিপ্লব হলো? এরপর দুই দশক যেতে না যেতেই আবার কেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এল? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। তবে উচ্চারণ করে কয়েকজনই, যাদের মধ্যে তরুয়া একজন।’
তরুয়ার বন্ধুদের থেকে তার সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন জানান, বন্ধুরা ওকে অসামাজিক ডাকত। আর ও খুব সহজেই সেটা মেনে নিত। তাদের বলত, ‘সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ইচ্ছা করে না।’ মাঝেমধ্যে তাদের খুব জ্বালাতন করত, খ্যাপাত। তারাও রেগে যেত। কিন্তু ও হাসত। বলত, রাগ করলেও আমি খ্যাপাব। বন্ধুরা তার সঙ্গে রাগ করে থাকতে পারত না। দু-একটা গালি দিয়ে ঠিকই হেসে ফেলত বন্ধুরা।
তারা জানায়, আমাদের বন্ধুটা অনেক সংগ্রাম করে এত দূর এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ চালাত। মাঝেমধ্যে ওকে খুব বকতাম। কারণ শুক্রবারগুলোয়ও সকাল ৯টার শাটলে ও টিউশনিতে যেত, ফিরত বিকালে। তরুয়া অনেক হিসাব করে চলত। কারণ ও জানত বাড়ি থেকে টাকা আনার পরিস্থিতি তার নেই। এমনও দেখা গেছে, যেদিন বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সে রাতে কলা-রুটি খেয়ে থেকেছে। বাসায় যেতে চাইত না, সে জন্যও বকা খেত বন্ধুদের। তরুয়া বলত, ‘বাসায় গিয়ে কী করব বল? তার থেকে এখানেই থাকি। টিউশনি তো মিস করা যাবে না।’ সারা দিন টিউশনি করে এসেও তরুয়া রাতভর পড়ত। পড়ালেখা শেষ করতে হবে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে, কত ভাবনা ছিল। সংগ্রাম যার সঙ্গী ছিল, সেই বন্ধুই কিনা হার মানল বুলেটের কাছে।