ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়রত কামরুন্নাহার রিতু। জন্মগতভাবে শরীরের বাম হাত-পা বিকল তার—কিন্তু তাতে কী! নিজের অদম্য ইচ্ছে আর পরিবারের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন ঝিনাইদহের এ শিক্ষার্থী। রিতুর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। তাই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার কারণে দূরে গিয়ে টিউশন নেয়া অসম্ভব হওয়ায় কলেজে বিজ্ঞান ছেড়ে মানবিকে ভর্তি হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়টা রিতুর জন্য সত্যিই একটা যুদ্ধ ছিল। কারণ পরিবারের কেউ রাজি ছিল না তাকে বাইরের জগতে একা ছাড়তে। যদিও পরে অনেক কষ্ট করে পরিবারকে রাজি করান তিনি। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর শুরুতে নিজেকে একা লাগত রিতুর। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা নিয়ে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করছেন। কামরুন্নাহার রিতু বলেন, ‘আমার বিভাগ সমতার কথা বলে। শিক্ষক ও সহপাঠীরা আমাকে আর দশজনের মতোই সমান নজরে দেখেন। সব থেকে বড় পাওয়া এ বিভাগের বন্ধুরা, পরিবারের মতো পাশে থেকে আমার পথচলাকে তারা মসৃণ করেছে।’
শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চান দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন রাফি। তিনি বর্তমানে ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়নরত। গ্র্যাজুয়েশন শেষে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশে যেতে চান। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বড় হওয়ায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জগুলো ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পারবেন বলে তার বিশ্বাস। নিয়মিত ক্লাসে যান এবং শিক্ষকের লেকচার ফলো করার চেষ্টা করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষা উপকরণ যথাযথ সময়ে কাছে পাওয়া। পরিবারের লোকজন সাইফুদ্দিনের পড়া রেকর্ড করে দেয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
সাইফুদ্দিন রাফি জানান, আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অধিকতর সহযোগিতাপূর্ণ। এখানে শিক্ষক ও সহপাঠীরা তার সম্পর্কে সচেতন এবং তাকে সহায়তা করেন। তবে তাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এমন কোনো বিশেষ সংগঠন নেই, যা তাদের কার্যক্রমকে সহজতর করতে পারে। এমতাবস্থায় একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুরুর দিকে অসংখ্য সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তা সত্ত্বেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়ন করতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট। রাফি বলেন, ‘বর্তমানে অসংখ্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছেন না। সবাইকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় এনে স্বাবলম্বী করা উচিত। যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়।’
শরীরের ডান অংশের দুর্বলতার কারণে বাম হাতে লিখেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্নের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আরাফাত আকাশ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হয়ে খেয়াল করেন ক্লাসরুমের হাতলওয়ালা চেয়ারগুলোর সবই ডানহাতি, বাঁহাতি চেয়ার নেই। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সমস্যার কথা জানাতে প্রথমে সংকোচ বোধ করেন তিনি। পরে সংকোচ ভেঙে বিষয়টি বিভাগকে জানালে কর্তৃপক্ষ বাঁহাতি চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেয়।
আকাশ বলেন, ‘এখনো আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের পরিবেশ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল-কলেজের তুলনায় অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সেগুলো নেয়া অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং হয়। এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী কাজ করছেন। এ কৃতিত্ব ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের। আমি ছোটবেলা থেকেই সবসময় মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। আমি তাই যেখানেই থাকি, মানুষের জন্য আমার জীবন বিলিয়ে দিতে চাই, বিশেষ করে রাস্তা যাদের ঘর হয়ে উঠেছে, সেসব শিশু এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। এককথায় আমার চারপাশের মানুষের পাশাপাশি আমার পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোনকে যেন জীবনের সব আনন্দ ছুঁয়ে যায়, ছোট্ট জীবনে এই আমার একমাত্র লক্ষ্য।’