দেশের বাজারে ২০০৩ সালে কাগজের দিস্তার দাম শুরু হতো ৬ টাকায়। বর্তমানে সবচেয়ে নিম্নমানের কাগজের দিস্তাও ১৮-২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আরেকটু ভালো মানের কাগজের দিস্তাপ্রতি দাম ছুঁয়েছে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। এ সময়ের ব্যবধানে কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স ও স্কুল ব্যাগের মতো অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে দুই-চার গুণ। যদিও দুই দশকে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় না করায় প্রাথমিক উপবৃত্তির টাকার মূল্যমান তলানিতে ঠেকেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ ও অংশগ্রহণের হার বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৩ সালে সরকারিভাবে দেশব্যাপী উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্প চালু হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাতা-কলমসহ আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ কিনতে শিক্ষার্থীপ্রতি মাসিক ১০০ টাকা করে দেয়া হয়। শুরুর দিকে বছরে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পেরে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের হারও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দেয়া হতো মাসে ৫০ টাকা করে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাসিক উপবৃত্তির পরিমাণ ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হয়। একইভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পরিমাণ ২৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়। অর্থাৎ গত দুই দশকে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে মাত্র একবার, তাও সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
অন্যদিকে বই-কাগজ-খাতা, কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স-পেন্সিল বক্স, ফাইল, স্কুল ব্যাগ ও স্কুল ড্রেসসহ প্রায় সব শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে দুই-চার গুণ। এর ফলে অপ্রতুল উপবৃত্তির অর্থে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে খাতা, কলম ও স্কুল ড্রেসের ক্রয়মূল্যসহ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে কাগজের মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এর প্রভাব পড়েছে বই-খাতার দামে। পাশাপাশি প্রতি অর্থবছরেই মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। অথচ এসবের সঙ্গে সমন্বয় করে উপবৃত্তির পরিমাণ সমন্বয় করা হচ্ছে না। বর্তমানে যে হারে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীর ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে না। ফলে উপবৃত্তি চালু হওয়ার পর এর যে আবেদন তৈরি হয়েছিল, এখন আর তা নেই।’
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনামূলক উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন খাতকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘অথচ শিক্ষা খাতের উদ্যোগগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হালনাগাদ করা হয়নি। বিশেষ করে উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ তো প্রতি অর্থবছরেই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে সমন্বয় করা প্রয়োজন।’
প্রতি বছরই বিভিন্ন হারে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ে। তবে ডলার সংকট ও আমদানি ব্যয় বাড়ায় গত ছয় মাসে শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে হু হু করে। নীলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের বাজার ও দোকান ঘুরে দেখা যায়, বই-কাগজ-খাতা, কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স-পেন্সিল বক্স, ফাইল, স্কুল ব্যাগসহ প্রায় সবকিছুর দাম কম-বেশি বেড়েছে। চলমান সংকটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কাগজ-খাতার দামে। প্রয়োজনীয় এ শিক্ষা উপাদানের দাম গত ছয় মাসে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সুলভ মূল্যের এক রিম নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৫৯০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৬০ টাকা। ভালো মানের বসুন্ধরা অফসেট কাগজের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা হয়েছে। আবার ৫০ টাকা দামের ৩০০ পৃষ্ঠার নোট খাতা ১১০ টাকা; ৩৫ টাকার নোট খাতা ৬৫ টাকা হয়েছে।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে এক কাগজ ব্যবসায়ী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কাগজের মান অনুযায়ী মূল্যবৃদ্ধির তারতম্য রয়েছে। কিছু কাগজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। তিন-চার মাসের ব্যবধানে হঠাৎ করেই এভাবে দাম বেড়েছে।’
কাগজের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বইয়ের বাজারে। দেশী লেখকদের বইয়ের মূল্যবৃদ্ধির হার ২০-৩০ শতাংশ। অ্যাপারাল লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক গোলাম মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কাগজ-কালির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশনা ব্যয় বেড়েছে। তাই ১০০ টাকার বই ১২০-১৩০ টাকা; ২০০ টাকার বই ২৪০-২৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।’
বইয়ের বাজারে কাগজের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কয়েকদিনের মধ্যে আরো বাড়বে বলে জানান নীলক্ষেতের দোকানিরা। এ সময় আলাপরত দোকানিরা একে অন্যকে বেশি করে বই মজুদ রাখার পরামর্শ দেন।
স্কুল ব্যাগের বাজারেও পড়েছে দামের প্রভাব। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাগের দাম প্রকারভেদে ৫০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। তবে আগে যার দাম ছিল ৩৫০ টাকা তা এখন ৪০০ টাকায় এবং ৫০০ টাকার ব্যাগ ৫৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে চীন থেকে আমদানি করা ব্যাগের দাম এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। নতুন চালান এলে দাম বাড়তে পারে। প্রায় একইভাবে বেড়েছে জ্যামিতি বক্স, ফাইলসহ অন্যান্য স্টেশনারি পণ্যের দাম। ২৫-৩০ টাকার ফাইলের দাম এখন ৪০-৫০ টাকা; ৩০-৩৫ টাকার রঙ পেন্সিল এখন ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০০ টাকা দামের স্ট্যাপলার মেশিন ১২০ টাকায়, ১১০ টাকার জ্যামিতি বক্স বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়।
বাজারে কলম-পেন্সিল, ইরেজার ও শার্পনারের দাম আগের চেয়ে বাড়লেও এখনো তা সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এসব উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির হার ৫-১০ ভাগ। এ বিষয়ে মো. অনিক নামের এক দোকানি বলেন, ‘এগুলোর পাইকারি দাম ডজনে ২-৩ টাকা বেড়েছে; শতকরার হিসাবে ৫-১০ ভাগ। তাই খুচরা দাম না বাড়িয়ে আমরাই ঘাটতি নিচ্ছি।’
নীলক্ষেতে খাতা কিনতে আসা আব্দুল মোমিন নামের এক শিক্ষার্থী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১০০ টাকা নিয়ে দুটি কিনতে এসেছিলাম। এসে দেখি এ টাকায় একটি খাতাও মিলছে না। পরে ৩০০ পেজের একটা নোট খাতা কিনেছি। দাম না কমলে আগামীতে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর হবে।’
বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার। বৃত্তির পরিমাণের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো না হলেও বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে বর্তমানে বৃত্তির পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা আসেনি। সরকার যেহেতু আর্থিকভাবে চাপে রয়েছে, এ সময়ে বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আনিসুর রহমান