বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি

যানজট কমানোর প্রকল্পই এখন যানজটের বড় কারণ

বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশের মাঝের দুই লেন বিআরটি কোম্পানির বাসের জন্য সংরক্ষিত। দুই পাশে দুটি করে লেন রাখা হয়েছে সাধারণ যানবাহনের জন্য। আপাতত ছয়টি লেনই ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সব যানবাহন। পরিষেবা শুরুর পর এসব যানবাহনের জন্য বিআরটি লেন পুরোপুরি বন্ধ হলে যানজট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

গাজীপুর-বিমানবন্দর মহাসড়কের যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের ভৌত কাজ এখন শেষের পথে। বিআরটি লেন ও স্টেশন নির্মাণের পর দেখা যাচ্ছে, করিডোরটিতে যানজট আরো বেড়েছে। দিনের ব্যস্ততম সময়ে করিডোরের ২০ কিলোমিটার অংশ পাড়ি দিতে সময় লাগছে ২-৩ ঘণ্টা, কখনো তারও বেশি।

বিআরটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশ পরিণত হয়েছে ছয় লেনের রাস্তায়। মাঝের দুই লেন বিআরটি কোম্পানির বাসের জন্য সংরক্ষিত। দুই পাশে দুটি করে লেন রাখা হয়েছে সাধারণ যানবাহনের জন্য। পরিষেবা শুরু না হওয়ায় আপাতত বিভিন্ন পয়েন্টে ছয়টি লেনই ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সব যানবাহন। পরিষেবা শুরুর পর এসব যানবাহনের জন্য বিআরটি লেন পুরোপুরি বন্ধ হলে বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের যানজট আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোরটির প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কলকারখানা। এসব কারখানার মালামাল পরিবহনের জন্য বিপুলসংখ্যক ভারী যানবাহন সড়কে চলাচল করে। মহাসড়কটি ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বারও। চলাচল করে বিপুলসংখ্যক আন্তঃজেলা পরিবহন। শুধু যানবাহন নয়, দুই পাশে কলকারখানার প্রভাবে এ মহাসড়কে পথচারীও বেশি। রয়েছে ফুটপাত দখল করে দোকানপাট স্থাপন, অপ্রতুল ড্রেনেজ অবকাঠামো, যান চলাচলে বিশৃঙ্খলার মতো নানা অব্যবস্থাপনাও। এসব কারণে করিডোরটিতে প্রতিদিনই দেখা দিচ্ছে যানজট, যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বিআরটি প্রকল্প।

সরজমিন বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোর ঘুরে দেখা গেছে, যানজট হচ্ছে মূলত স্টেশনসংলগ্ন এলাকাগুলোয়। করিডোরে বিআরটির স্টেশন রয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে সাতটি স্টেশন ফ্লাইওভারে। মাটিতে থাকা বাকি ১৮ স্টেশনের প্রতিটিতেই দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট। একটি স্টেশনে তৈরি হওয়া যানজট কখনো গিয়ে ঠেকছে পেছনের আরেকটি স্টেশনে।

বিআরটি স্টেশন এলাকাগুলোয় সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়াকেই এ যানজটের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিআরটি করিডোরের দুই পাশের সার্ভিস লেনের প্রশস্ততা সাত মিটার। কিন্তু স্টেশন এলাকাগুলোয় তা নেমে এসেছে ছয় মিটারে। স্টেশন এলাকা পার হওয়ার সময় গতি কমিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে যানবাহন। ধীরগতির মধ্যে গাড়ির চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিচ্ছে যানজট।

স্টেশন নির্মাণের পর দুইপাশে যতটুকু জায়গা রাখা হয়েছে তা সাধারণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন পরিবহন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পের পরিকল্পনাটিই ছিল ভুল। এর সঙ্গে নকশায় ভুল করা হয়েছে। স্টেশন বানাতে গিয়ে সড়ক সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় বিআরটি চালু হলে এখানকার যানজট আমরা যতটা কল্পনা করছি, তার চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

বিআরটি প্রকল্পের সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগই আর অবশিষ্ট নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটিতে প্রধান বিনিয়োগকারী ছিল এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক)। বিআরটি সফল হবে না বুঝতে পেরে তারা এরই মধ্যে সরে গেছে। কারণ তারা দুর্নামের ভাগীদার হতে চায় না। সরে এসেছে অপারেশন মডেল তৈরির কাজে থাকা পরামর্শক হিসেবে বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ও ভারতের সেপ্ট ইউনিভার্সিটিও (সেন্ট্রার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্ল্যানিং অ্যান্ড টেকনোলজি)।’

এমন প্রেক্ষাপটে এ প্রকল্পের জন্য বাস না কিনে, করিডোরটি সব ধরনের যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন অপারেশনে এসে যদি আরো ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা কাজে আসবে না। সংগত কারণে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। এখনো এটাকে রিভিজিট করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিআরটির সফলতা নিয়ে যেহেতু সন্দেহ দেখা দিয়েছে, আর সে সন্দেহের বশে মূল অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এত বছর থাকার পর চলে গেছে, সেক্ষেত্রে এ প্রকল্পে বিনিয়োগ আদৌ কতটা কাজে আসবে তা ভাববার বিষয়। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

বাস্তবায়নের এ পর্যায়ে এসে বিআরটি প্রকল্প পুনর্বিবেচনার আর কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌এখন বিআরটি প্রকল্পের যেসব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, সেগুলো অনুমোদিত নকশা মেনেই করা হয়েছে। এখন তো আর এ নকশা পরিবর্তন করা যাবে না। যখন এ প্রকল্পের নকশা করা হয়, তখনো কিন্তু ফুটপাতে পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। বিষয়টি তো নকশায়ই উঠে আসার কথা। এখন যদি আমরা ফুটপাত ও সড়ক প্রশস্ত করি, তাহলে আমাদের নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, যা চলমান প্রকল্প দিয়ে সম্ভব নয়।’

বিআরটি বাদ দিয়ে করিডোরটি সাধারণ যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের এখনো এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই।’

আরও