জ্বালানি সংকটে ভুগছে দেশের জ্বীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস বা কয়লার সংস্থান করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্থাপিত আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখন উৎপাদনে কার্যক্রম শুরুর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ডিসেম্বরে। এটি উৎপাদনে গেলে দেশে স্থাপিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা দাঁড়াবে ৭ হাজার ৩১২ মেগাওয়াটে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করেছে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল)। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কমিশনিং ও উৎপাদন শুরুর জন্য ১ লাখ ২৮ হাজার টন কয়লা মজুদ করেছে। দীর্ঘমেয়াদে কয়লা সরবরাহের জন্য দুই-একদিনের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে কোম্পানিটি। আরএনপিএলের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ডিসেম্বরে গ্রিডে সংযুক্ত হলেও এর প্রথম ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) উৎপাদনে যাবে আগামী বছরের মার্চে। আগামী জুনের মধ্যে এখান থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায় আরএনপিএল। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিপিডিবি বা বিদ্যুৎ বিভাগ চাইলে এবং ব্যাকফিড পাওয়ার সংযোগ পেলে যেকোনো সময় উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত তারা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এমন এক সময় উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠেছে, যখন দেশের আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানোর মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। গ্যাসের সংকট থাকায় নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে তিনটি বৃহৎ সক্ষমতার (প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ বিপিডিবির বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া পড়ছে কেন্দ্রগুলোর কাছে। ফলে আরএনপিএলের নতুন কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলে বিল পরিশোধে ব্যয় বাড়বে বিপিডিবির। আবার উৎপাদনে রাখা না গেলে এর বড় সক্ষমতার ভাড়া হিসেবেও প্রচুর পরিমাণ অর্থ গুনতে হবে সংস্থাটিকে।
কয়লাভিত্তিক বড় অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন জ্বালানির অভাবে চাহিদামাফিক উৎপাদন করতে পারছে না। জ্বালানি সংকটে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ডিসেম্বরের আগে এটি চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ৩০৭ মেগাওয়াট বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও বন্ধ রয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি চালু রয়েছে। বন্ধ রয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এসএস পাওয়ারের একটি ইউনিট। এছাড়া ভারত থেকে আদানির একটি ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকায় পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট ৭ নভেম্বর থেকে রক্ষণাবেক্ষণে যাবে। এটি প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকবে বলে বিসিপিসিএল সূত্রে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অব্যাহতভাবে উৎপাদন সংকটে পড়ার কারণ এগুলোর জ্বালানি আমদানি বা এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান নিয়ে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। পরিকল্পনার অভাব ও জ্বালানি খাতে অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতার কারণে বড় সক্ষমতার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন চালানো যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অনুমোদন দেয়া হয়েছিল মূলত বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর পরিকল্পনা থেকে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা না থাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। এগুলো কীভাবে চালানো হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করতে হলে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখা যাবে না।’
দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্তমান সক্ষমতা ৫ হাজার ৯৯২ মেগাওয়াট। আরপিসিএল-নরিনকোর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা যুক্ত করলে দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩১২ মেগাওয়াটে। আরপিসিএল-নরিনকোর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে। যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত এ কেন্দ্রের ৫০ শতাংশ মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের। বাকি ৫০ শতাংশের মালিক চীনা কোম্পানি নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন লিমিটেড। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৫৪ কোটি ডলার। আরপিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি অক্টোবর পর্যন্ত ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৯ শতাংশ।
আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য সংস্থাটি ১ থেকে ৮ নভেম্বর পায়রা-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইনের শাটডাউন চেয়েছিল। কিন্তু সঞ্চালন লাইনটি এখন পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ সঞ্চালনে নিয়োজিত রয়েছে। এ অবস্থায় তা বন্ধ করে আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত করার সুযোগ নেই বলে জানায় বিপিডিবি। এ বিষয়ে সংস্থাটির বক্তব্য হলো পায়রার বিদ্যুৎ বন্ধ হলে সারা দেশে ব্যাপকহারে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আরপিসিএল-নরিনকো বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করা নিয়ে ৪ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে আরএনপিএল, বিপিডিবি ও পিজিসিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ১ নভেম্বর থেকে ব্যাকফিড পাওয়ার প্রাপ্তি সাপেক্ষে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে চেয়েছিল আরপিসিএল-নরিনকো। কিন্তু বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা ও লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে এখনই তাদের ব্যাকফিড পাওয়ার দিতে চাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি। ফলে এ সময়সীমা পিছিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালাতে দৈনিক প্রায় ১২ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এরই মধ্যে তিন ধাপে জ্বালানি আমদানি করেছে কোম্পানিটি। তবে পায়রার বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ রাখা যায়নি বলে প্রস্তুত হলেও কেন্দ্রটির উৎপাদন পিছিয়েছে অন্তত চার মাস।
এ বিষয়ে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সেলিম ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। কেন্দ্র চালু করার জন্য এখন ব্যাকফিড পাওয়ার প্রয়োজন। চলতি মাসের শুরুতে হওয়ার কথা থাকলেও সেটি এখনই হচ্ছে না। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যাকফিড পাওয়ার দেয়া হবে। এরপর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম ইউনিট চালু হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের জুনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’