আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থমন্ত্রী, যিনি দ্বাদশ নির্বাচনের পর এ দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এ শিক্ষক ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই দেশ ছাড়েন। সেই থেকে আছেন আত্মগোপনে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন তারই ছাত্র ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর অর্থের পাশাপাশি বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টারও দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সরাসরি ছাত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে। সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একই বিভাগে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হন। তাদের সঙ্গে একই শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তারও দুই বছর আগে একই বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও সালেহউদ্দিন ভর্তি হয় তারও দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে। সেই অর্থে আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাদের শিক্ষক ছিলেন। আমি নিজেও একপর্যায়ে তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তবে তিনি আমাদের কোনো কোর্স পড়াননি।’
এসএসসি পাসের পর ১৯৬৩ সালে সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভর্তি হন মানবিকে। তখনই মির্জা ফখরুল ও সালেহউদ্দিন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৬৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও মির্জা ফখরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। এদিকে বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলে সুযোগ পান সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে তার কোনোটিতেই না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও ঢাবির অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ওই সময় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
স্মৃতিচারণ করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে আমরা চার-পাঁচ মাসের মতো পেয়েছি। উনি আমাদের মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং বিষয়ে পড়াতেন।’
শিক্ষাজীবন ছেড়ে আবুল হাসান মাহমুদ আলী ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুজিবনগর সরকারের যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯২ সালে ভারতের সঙ্গে তিন বিঘা করিডোর বাস্তবায়ন চুক্তি ও মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তন চুক্তির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন।
পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে অবসর নেয়ার পর আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং দলটির নির্বাচনী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হন। এরপর আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির কো-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলের মনোনয়ন নিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দিনাজপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে নবগঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি আবারো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের ১৮তম অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সংকট, রাজস্ব আহরণ, খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতের সুশাসন ফেরানোর দায়িত্বভার পড়ে তার ওপর। পাশাপাশি ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন শর্ত ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপও ছিল। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে মন্ত্রী হিসেবে তিনিও পদচ্যুত হন। আবুল হাসান মাহমুদ আলী যদিও দেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগেই। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিনই তার সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এর একদিন পরই তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব দেয়া হয় এ অর্থনীতিবিদকে। সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা হিসেবে সালেহউদ্দিন আহমেদের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক সপ্তাহ পর শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তাদেরই বন্ধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে না থাকলেও দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র। বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্যার আমাদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমরা ওনার ক্লাস পেয়েছি।’
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানা সময়ে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে সরকারেও। তবে কখনই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কিংবা ক্ষমতার পালাবদলে কোনো অর্থমন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি। সর্বশেষ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তেই দেশ ছাড়েন সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার ঠিক আগের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পতনের পর যারা পালিয়েছেন তাদের কারো মধ্যেই দেশে অবস্থান করার মতো সৎসাহস ছিল না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবেই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার কারণেই তাদের এ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
বিগত সরকারের দায়িত্বশীলদের পালিয়ে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিষয়ে মন্তব্য না করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি সুনির্দিষ্টভাবে কারো কথা বলব না। তবে তাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। তারা নিজেরাই নিজেদের এ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছেন। দেশে কর্তৃত্ববাদের যে বিকাশ ঘটে তাতে তারা সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন। এখন তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাদের কারো যদি সৎসাহস থাকত তাহলে দেশ ছেড়ে পালাতেন না। শুধু কর্তৃত্ববাদ নয়, যারা পালিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।’