সাড়ে ১০ হাজার কোটির বেশি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর যানবাহন চলাচল শুরুর পর থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৮২টি যানবাহন এ টানেল পারাপার হয়েছে। যদিও টানেল নির্মাণের আগে করা সমীক্ষায় পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, চালুর প্রথম বছরে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলবে ১৭ হাজারের বেশি।
প্রত্যাশিত পরিমাণে যানবাহন না চলায় লাভ হওয়া দূরের কথা, টানেলের দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় তুলে আনাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টানেল নির্মাণের জন্য নেয়া চীনা ঋণ। গ্রেস পিরিয়ড শেষে এরই মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন টানেলটি নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয়ের হিসাবে পদ্মা সেতুর চেয়ে দেড় গুণ খরচ হয়েছে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের পরিচালন ব্যয় সাড়ে তিন গুণ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কর্ণফুলী নদীতে টানেল বানিয়ে মেগা প্রকল্পের নামে মেগা অপচয় করা হয়েছে বলে অভিমত তাদের।
‘কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ কতটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত?’ শিরোনামে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। গবেষণায় অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও টানেলটির বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরেছেন তিনি।
টানেল পরিচালনা পদ্ধতিটিকে হাসপাতালের আইসিইউর সঙ্গে তুলনা করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেকোনো টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কর্ণফুলী টানেলও এর ব্যতিক্রম নয়। দ্বিতল পদ্মা সেতু পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে যেখানে পাঁচ বছরে ৬৯৩ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, সেখানে একই সময়ের জন্য কর্ণফুলী টানেল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে ৯৮৪ কোটি টাকা। কিলোমিটারপ্রতি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে পদ্মা সেতুর চেয়ে সাড়ে তিন গুণ অর্থ খরচ হচ্ছে কর্ণফুলী টানেলে।
কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে শাহ আমানত সেতু। এ সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের টোল হার যানবাহনভেদে আড়াই থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্য টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলা। যদিও বাইসাইকেল, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের মতো ‘লোকাল ট্রাফিক’ পারাপারের সংস্থান না রাখায় ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনাটি হুমকির মুখে পড়েছে।
যানবাহন চলাচলের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর অনুমোদিত হেডরুম ৫ দশমিক ৫ মিটার। সড়কের ওপর কোনো ফ্লাইওভার বা সমজাতীয় অবকাঠামো করলে যানবাহন নির্বিঘ্নে পারাপারের জন্য সেটির উচ্চতাও এ মানদণ্ড অনুযায়ী করা হয়। কর্ণফুলী টানেলে হেডরুম রাখা হয়েছে ৪ দশমিক ৯ মিটার। উচ্চতা কম হওয়ায় টানেল দিয়ে ভারী কার্গোর মতো যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকারও বিরূপ প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন যানবাহন চলাচলে। কর্ণফুলী নদীতে টানেলের বদলে ধনুকাকৃতির (আর্চ) লম্বা স্প্যান, সাসপেনশন ও কেবল দিয়ে ঝুলন্ত সেতু তৈরি করে কম খরচে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই একটি অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কর্ণফুলী টানেলকে একটি অপচয় প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করে ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যানবাহন চলাচলের যে পূর্বাভাস সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় দেয়া হয়েছে, সেটি পুরোপুরি ফরমায়েশি। শুধু কর্ণফুলী টানেল নয়, বিগত সময়ের বেশির ভাগ প্রকল্পেই এমন ফরমায়েশি পূর্বাভাস বা প্রাক্কলন করা হয়েছে মূলত প্রকল্পগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে দেখানোর জন্য। ভবিষ্যতে যেন কেউ কর্ণফুলী টানেলের মতো টাকা অপচয়ের কোনো প্রকল্প করতে না পারে, সেজন্য এটি নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধন হয় গত বছরের ২৮ অক্টোবর। পরদিন শুরু হয় যানবাহন চলাচল। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যান চলাচল শুরুর পর ২৯৫ দিনে ১২ লাখ ৪ হাজার ১৯৮টি যানবাহন কর্ণফুলী টানেল পারাপার হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে টানেল পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা ৪ হাজার ৮২। এ টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত চলাচলকারী যানবাহনের বড় একটি অংশ পর্যটনকেন্দ্রিক। অর্থাৎ টানেল ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল এটি ভ্রমণ করে দেখা।
বর্তমানে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা দিয়ে টানেলের কার্যকারিতা বোঝা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। কর্ণফুলী টানেলসহ চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন এ প্রকৌশলী।
তিনি বলেন, ‘ওপারে তো কোনো ইন্ডাস্ট্রিই হয়নি। তাহলে যান চলাচল বাড়বে কীভাবে? পরিকল্পনাধীন পতেঙ্গা টার্মিনাল হয়নি, বে টার্মিনাল হয়নি, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়নি। যতদিন এসব অবকাঠামো না হবে, ততদিন সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।’
২০১৭ সালে কর্ণফুলী টানেল চালু হবে ধরে নিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যান চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রাক্কলন অনুযায়ী, চালুর পর ২০১৭ সালে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার ৩৭৪টি যানবাহন চলবে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হবে ২০ হাজার ৭১৯। ২০২৫ সালে হবে ২৮ হাজার ৩০৫।
কর্ণফুলী টানেলে যান চলাচলের পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে গতকাল একাধিকার যোগাযোগ করা হয় সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে। তাদের কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি।
তবে এর আগে সেতু বিভাগের সচিব বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘যত দিন যাবে টানেলের আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং একসময় লাভজনক অবস্থায় চলে যাবে।’ বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপকালে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরীও।