১৯৭৫ সালের নভেম্বর। প্রথম সাতদিনের মধ্যেই দুই দফা অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী হয় বাংলাদেশ। রক্তাক্ত ওই সময়ে দেশ চলে গিয়েছিল গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটান খালেদ মোশাররফ। আর ৭ নভেম্বর পাল্টা আরেক অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় তার। সে সময় জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানটি ছিল ভারতপন্থী একটি অভ্যুত্থান। এ জনশ্রুতিকেই বিভিন্ন সময় বিশ্লেষকদের বক্তব্যে তার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
দিনটি ছিল ৩ নভেম্বর সোমবার। ক্ষমতায় খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন সরকার। প্রথম প্রহরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশাপাশি রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার অনুগতরা। নিজেদের শক্তি জানান দিতে এবং মোশতাক সরকারের অনুগত ট্যাংক ক্রুদের মনোবল নষ্টের উদ্দেশ্যে ওইদিন রাজধানীর আকাশে ওড়ানো হয় একটি মিগ যুদ্ধবিমান ও সশস্ত্র হেলিকপ্টার।
শক্তির পাল্লায় পিছিয়ে পড়া খন্দকার মোশতাক রক্তপাত ও ভারতীয় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরির আশঙ্কা থেকে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আপসে আসেন। এতে মোশতাককে ক্ষমতায় নিয়ে আসা মেজররা নিরাপদে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে
আপসে বাধ্য হওয়ার আগে কুমিল্লা সেনানিবাসে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন খন্দকার মোশতাক। সে সময় তাকে জানানো হয়, কুমিল্লা সেনানিবাসের কমান্ডার শুধু সেনাপ্রধান বা সিজিএসের আদেশে কাজ করবেন।
সে সময় বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ডেভিড ইউজিন বোস্টার। ওই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ১০ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন তিনি। ওই প্রতিবেদন এখন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ানের নথিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ভিত্তিতে দেয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশের সেনাবাহিনীতে বেশকিছু পদোন্নতি হয়। বিষয়টি ক্ষুব্ধ করে তোলে বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মোশাররফকে। এসব পদোন্নতির পেছনে অভ্যুত্থানকারী মেজরদের হাত ছিল ধরে নেয়া হয়। এছাড়া অভ্যুত্থানকারী মেজররা তদন্তের জন্য সেনা কর্মকর্তাদের একটি তালিকা করেছিলেন। এতে খালেদ মোশাররফের নামও ছিল বলে গুঞ্জন ওঠে। এ অবস্থায় ৩ নভেম্বর প্রথম প্রহরে অভ্যুত্থান শুরু হয়।
জনশ্রুতি ও বিশ্বস্ত একটি সূত্রের বরাত দিয়ে এতে আরো বলা হয়, ‘আমরা এখনো জানি না, খালেদ মোশাররফ এ অভ্যুত্থানের মূল স্থপতি কিনা, তা আমরা সরাসরি বলতে পারছি না। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র আমাদের জানিয়েছে, খালেদ মোশাররফ কেবল মোশতাক সরকারে অভ্যুত্থানকারী মেজরদের বিশেষ ভূমিকার ইতি ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অধীনস্থদের সঙ্গ দিয়েছিলেন। ওই মেজররা এ ভূমিকার সুবাদে বেশকিছু সামরিক কর্মকর্তাকে হেনস্তাও করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা ছিল, পাল্টা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব নেয়ার মাধ্যমে অধীনস্থদের পরিকল্পনাগুলোরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া, যাতে রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়।’
বোস্টার লিখেছেন, খন্দকার মোশতাকের কাছে চারটি দাবি তোলেন খালেদ মোশাররফ। এগুলো হলো মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করতে হবে, অভ্যুত্থানকারী মেজরদের সেনাবাহিনীর নিয়ম ও শৃঙ্খলার অধীনে ফিরিয়ে আনতে হবে, সরকারের প্রতি আনুগত ট্যাংক বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হবে এবং মোশতাক নিজে ক্ষমতায় থাকবেন।
এর মধ্যে সোমবার রাতে ঢাকা কারাগারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে বোস্টারের ভাষ্য হলো ‘এ কথা বিশ্বাস করার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে যে শুরুতে মূলত মোশতাকের মৃত্যু হলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় মোশতাকের সম্পৃক্ততা নিয়ে রহস্য দানা বাঁধে হত্যাকারী মেজরদের ঢাকা ত্যাগের পর। একটি সূত্রের ভাষ্যমতে, সোমবার মধ্যরাতে মেজরদের বহনকারী বিমানটি ঢাকা ত্যাগের আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে খালেদ মোশাররফের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এ হত্যার একটি উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো ভারতপন্থী সরকারের সম্ভাব্য নেতৃত্বকে অপসারণ করা।’
মেজরদের দেশত্যাগের ঘটনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। পাশাপাশি মঙ্গল ও বুধবার খন্দকার মোশতাক এবং মোশাররফের মধ্যে আলোচনা চলে। বুধবার গভীর রাতে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান চিফ অব স্টাফ হিসেবে মনোনীত করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে মোশতাকের পদত্যাগের ঘোষণা প্রচার হয় এবং প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। বৃহস্পতিবার সায়েম শপথ নেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সংসদ ভেঙে দেন। মন্ত্রিসভা সাবেক সরকারের নেতাদের হত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছে বলে সে সময় প্রচার হয়।
বোস্টার লিখেছেন, সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে তার সহকর্মী অনেক অফিসার ভালোভাবে নেননি। তাদের কাছে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। সে সময় খালেদ মোশাররফকে দেখা হচ্ছিল ভারতীয় নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে। এ ধারণাকে প্রকট করে জেল হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় মঙ্গল ও বুধবারের দুটি মিছিলের ঘটনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার প্রথম প্রহরেই বিদ্রোহ করে বসে সেনাবাহিনীর নিম্নপদস্থ সৈনিকরা। উৎখাত হন খালেদ মোশাররফ ও তার অনুগতরা। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন খালেদ মোশাররফ। সারা রাত ও সারা দিন ধরে ঢাকায় গোলাগুলি চলে। একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় প্রায় ৩০ জনের মৃত্যু হয়। অন্যান্য প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে এ সংখ্যা শতাধিক।
সে সময় খালেদ মোশাররফকে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে দেয়া তকমা প্রসঙ্গে ডেভিড বোস্টারের বক্তব্য হলো ‘মোশাররফকে ভারতপন্থী হওয়ার জনশ্রুতিটির কিছু অসুবিধা রয়েছে। কেবল এ বক্তব্যটি ছাড়া শুরুতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলোকে অরাজনৈতিক বলে মনে হবে। যারা মোশতাক ও মেজরদের উৎখাত করেছিলেন, তারা প্রাথমিকভাবে মেজরদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন। পাল্টা অভ্যুত্থানটি ছিল নিম্নপদস্থ সৈনিকদের কাজ, যারা খালেদ মোশাররফের চেয়ে জিয়াউর রহমানকে বেশি পছন্দ করতেন। তাছাড়া খালেদ মোশাররফের আনুগত্য কোনদিকে, সেটি নিয়েও চিন্তিত ছিলেন তারা। আমাদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে বিগত সপ্তাহের কোনো শাসনব্যবস্থাই মার্কিনবিরোধী, ভারতপন্থী বা সোভিয়েতপন্থী ছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা মনে করেন, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ জাতির সামনে এর উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে না পারা। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) মনজুর কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থানের পর জাতির উদ্দেশে কোনো ভাষণ দেননি। তার অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে জাতির উদ্দেশে কোনো বার্তা ছিল না। খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই নীলক্ষেত থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স ক্লাব ও ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তখন মুহসীন হলের মাঠসংলগ্ন গেটের সামনে দাঁড়ানো। ওই মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিলেন। তখন সবাই ধারণা করে নিল এটা আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক অভ্যুত্থান। তখন সারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগবিরোধী মুডে ছিল। এ কারণেই মানুষ খালেদ মোশাররফের বিপক্ষে গেল।’
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বোস্টার লিখেছেন, নিম্নপদস্থ সৈনিকদের বিদ্রোহ সফল হওয়ার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তারা সেনা নেতৃত্বের কাছে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করে। তাণ্ডবকারী সৈনিকদের ভয়ে বিপুলসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যান এবং বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের হত্যার ঘটনা ঘটে। মোশাররফের ক্ষমতাচ্যুতের পর জেনারেল জিয়া, মোশতাক এবং অন্য সহযোগীদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হয়। মোশতাককে নতুন করে রাষ্ট্রপতি পদের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে বৈরী পরিস্থিতিতে দেশে একজন অরাজনৈতিক ও অবিতর্কিত রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কারণে বিচারপতি সায়েমই রাষ্ট্রপতির পদে বহাল থাকেন এবং সামরিক আইন প্রশাসনের প্রধানের কার্যভারও তার কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।