দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কোনো কোনো ফসলের ক্ষেত্রে এ হার নেতিবাচক। উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষকের আয় না হওয়াসহ নানা কারণ কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বৈশ্বিকভাবে কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা আসতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কভিডকালে তা বেশ টের পাওয়া গেছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে এখনো বেশ ভোগাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
ন্যাশনাল ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি পলিসি (এনএফএনএসপি) অনুযায়ী, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ তিন অর্থবছরে চাল আমদানি শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি চাহিদার ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ চাল আমদানি করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয় ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাল আমদানি করতে হয়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৭ হাজার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪০ লাখ ১২ হাজার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন গম আমদানি হয়।
সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের আবাদি জমি বেড়েছে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির কারণে। সে কারণে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের উৎপাদনশীলতা খুব বেশি বাড়ছে না। ফসলের নিবিড়তা তো আর খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। সে কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এটায় মনোযোগ দিতে হবে। ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। তারা কীভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে সেগুলো স্টাডি করতে হবে। তাদের থেকে শেখা যায়। এজন্য নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। জলবায়ুসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় খাদ্যশস্য উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কম। এ কারণে উৎপাদন বাড়লেও আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমছে না। আবার উৎপাদনের তথ্যও যথাযথভাবে নেয়া হয় না। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বড় গরমিল দেখা যায়। প্রধান খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হলেও এর বাইরের শস্যগুলোর দিকে নজর দেয়া হচ্ছে কম।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশ। এছাড়া গমে ৩ শতাংশ, ভুট্টায় ৮, আলুতে ১, ডালশস্যে ৬, বেগুনে ৫, কুমড়ায় ৭, মটরশুঁটিতে ৯, তেলশস্যে ৭, কলায় শূন্য দশমিক শূন্য ২, পেয়ারায় ২ ও কাঁঠালে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এছাড়া লালশাকে ১ শতাংশ, আমে শূন্য দশমিক ২ ও আনারসে ২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আবার ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশ। এছাড়া গমে ২, ভুট্টায় ৬, আলুতে ২, ডালশস্যে ৫, বেগুনে ৫, কুমড়ায় ৭, মটরশুঁটিতে ৬, তেলশস্যে ৬, পেয়ারায় ১, লালশাকে ৩ ও কাঁঠালে ১ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর কলা উৎপাদনে শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ, আমে শূন্য দশমিক ৩৪ ও আনারসে ২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অর্থাৎ চাল, বেগুন, কুমড়া ও আনারসের ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার একই। শুধু আলু ও লালশাকের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। তবে গম, ভুট্টা, ডালশস্য, মটরশুঁটি, তেলশস্য, কলা, পেয়ারা, আম ও কাঁঠাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় কমেছে।
তিন অর্থবছরে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল গড়ে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও কোনো অর্থবছরেই সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ দশমিক ২ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
এফপিএমইউর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধানের নতুন জাত এসেছে ১৩টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে চারটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়। গমের ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিনটি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচটি জাত উদ্ভাবন হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভুট্টার দুটি, আলুর ১০, ডালশস্যের এক, সবজির ১০, ভোজ্যতেল শস্য দুটি, ফল দুটি, মসলা দুটি, পাট দুটি ও আখের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভুট্টার একটি, আলুর একটি, ডালশস্যের দুটি, সবজির ছয়টি, ভোজ্যতেল শস্য দুটি, ফল তিনটি, মসলা চারটি, পাট একটি ও আখের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভুট্টার একটি, আলুর আটটি, ডালশস্যের একটি, সবজির একটি, ভোজ্যতেল শস্য দুটি, ফল তিনটি, মসলা একটি ও পাটের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে ভুট্টা উৎপাদন হতো ১০ লাখ টন। এখন ৫০ লাখ টনের বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির ফলে ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বেড়েছে। প্রধান ফসলের বাইরে একটির উৎপাদন বাড়লে অন্যটির উৎপাদন কমবে, এটা স্বাভাবিক। কারণ জমি তো বাড়ানোর সুযোগ নেই। আবার সার্বিকভাবে ফসলের উৎপাদনশীলতা খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগও নেই। চীনে ৬০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হয়। এ কারণে তাদের উৎপাদনশীলতা এত বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে তো হাইব্রিড খুব বেশি আবাদ হয় না। আমাদের উৎপাদনশীলতা চালের ক্ষেত্রে মোটামুটি ভালো। আউশে উৎপাদনশীলতা অনেক কম। ফলে সার্বিক উৎপাদনশীলতা কমে যায়। আবার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আবহাওয়া অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা। কৃষককে সারসহ কৃষি উপকরণ আরো সহজলভ্য করতে হবে। সরকারিভাবে আরো বেশি সংগ্রহ করতে পারে। এক্ষেত্রে শর্তগুলো শিথিল করতে হবে। এতে আমদানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুরনো জাতগুলোকে নতুন জাত দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে, যেন উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। একই ফসল টানা একই জমিতে চাষ করলে ফলন কমে যায়। ফলে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এক ফসল শেষ হলে অন্য ফসলের চাষাবাদ এবং একই জমিতে একই সঙ্গে একাধিক ফসল আবাদে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ধানের ক্ষেত্রে এমন কিছু জাত উদ্ভাবন হয়েছে যেগুলো স্বল্পমেয়াদি। ফলে সময় অনেক কম লাগছে। যেহেতু উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই, সেক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ভালো জাত উদ্ভাবন করছে, যেগুলো উচ্চফলনশীল। আগে বিভিন্ন সবজি শুধু শীতকালেই পাওয়া যেত, কিন্তু এখন সারা বছরই সেগুলো পাওয়া যায়। ধান ও শাকসবজির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়েছে। তবু এখন আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভালো প্র্যাকটিসগুলো অনুসরণের চেষ্টা করছি।’
সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সার, বীজসহ বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হয় কৃষি উৎপাদনের জন্য। এটা সেবা খাত। এজন্য কৃষককে নানা ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সহায়তা দেয়া হয়। এর বাইরেও প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা থাকে শুধু প্রান্তিক কৃষককে সহায়তা দেয়ার জন্য। এগুলো মূলত দেয়া হয় সম্প্রসারণে উৎসাহিত করার জন্য।’
এদিকে ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত ধানের গড়ে আবাদি জমি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে ভুট্টায় ২ দশমিক ৫, তেলশস্যে ৫, মসলায় ৩, ডালশস্যে ২ ও সবজিতে ১ শতাংশ হারে আবাদি জমি বেড়েছে। আবার একই সময়ে গম শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, আলু শূন্য দশমিক ৩, আখ ৪, ফল ৭ ও পাটের ১ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমেছে।
গত বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত কৃষিশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে ফসলের নিবিড়তার জাতীয় গড় ১৭২ শতাংশ থাকলেও ২০১৯ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২১৪ শতাংশে। বর্তমানে নিট আবাদি জমি রয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৯০২ একর। এর মধ্যে ১ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০৮ একরে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হয়। তাই ফসলাধীন মোট জমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫০ একর।