জ্ঞান সৃষ্টি, গবেষণার উৎকর্ষ এবং উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় গবেষকদের পিএইচডি (ডক্টরেট অব ফিলোসফি) অভিসন্দর্ভকে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ তিন দশক দেশে পিএইচডিধারীর সংখ্যা ছিল বেশ কম। তবে গত দুই দশকে এ সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। দেশে এখন পিএইচডিধারীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৭০৪ বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জনশুমারি
ও গৃহগণনা-২০২২-এর ‘ন্যাশনাল রিপোর্টে’ উঠে
এসেছে। গত ২৮ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিবিএস।
বয়সভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী এসব পিএইচডিধারীর অধিকাংশই চল্লিশোর্ধ্ব—২৯ হাজার ৯৯৮ জন। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী আছেন ১৫ হাজার ১১৪ জন। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সসীমার অন্তর্ভুক্ত আছেন ৫ হাজার ৮০৯ জন। আবার এ তালিকায় ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমার অন্তর্ভুক্তরাও আছেন, যার সংখ্যা ৭৮৩ জন।
এর মধ্যে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী অন্তর্ভুক্তদের পিএইচডি অর্জনের বিষয়টি নিয়ে ভালোমতো অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন দেশের শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে পিএইচডি করার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে তাকে আগে অবশ্যই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে খুব ভালো ফল অর্জন না করতে পারলে তাকে এমফিলও করে আসতে হয়। আবার স্নাতকোত্তরের আগে স্নাতক এবং মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে আসতেও অনেক সময় প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে একজন শিক্ষার্থীর ২৫ বছর বয়সের আগে পিএইচডি অর্জন অনেক চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন একটি বিষয়। ৩০ বছর বয়সের মধ্যে অর্জন করাও অনেক কঠিন।
তথ্য অনুযায়ী, পিএইচডিধারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৫১৭। নারী আছেন ১৪ হাজার ১৮৭ জন। যদিও ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমার অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে নারী পিএইচডিধারী তুলনামূলক বেশি—৪০৩ জন। পুরুষ পিএইচডিধারী আছেন ৩৮০ জন।
এত কম বয়সে পিএইচডি অর্জন কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করতে ১৭ থেকে ১৯ বছর প্রয়োজন হয়। এর পর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতেও কমপক্ষে পাঁচ-সাত বছর দরকার পড়ে। আবার পিএইচডির জন্যও অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত হয়। এর মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর স্টাডি গ্যাপ, সেশন জটিলতার কারণে কিছু সময় অপচয় হতে পারে। এ অবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর জন্য ২৫ বছর বয়সের মধ্যে পিএইচডি সম্পন্ন করা বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেও পিএইচডি করতে চাইলে সেটা অনেক চাপের বিষয়।’
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পিএইচডির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ৩০ হাজার ১৬৬ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে ৭ হাজার ১৪৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪ হাজার ১৬৪, খুলনা বিভাগে ২ হাজার ৯৩৮, রংপুরে ২ হাজার ১২০, ময়মনসিংহে ২ হাজার ৩৯, সিলেটে ১ হাজার ৯৯০ এবং বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ১৪৩ জন পিএইচডিধারী রয়েছেন।
এ তালিকার ২০ থেকে ২৪ বয়সসীমার অন্তর্ভুক্তরা দেশে নাকি দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘বিষয়টিকে মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের আগে দেখতে হবে এসব পিএইচডিধারী দেশের অভ্যন্তরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন, নাকি বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন। তখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলা সহজ হবে। দেশের অভ্যন্তরে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এত অল্প বয়সে পিএইচডি নেয়া খুবই কঠিন বিষয়।’
এক সময় শিক্ষক ও গবেষকদের মধ্যেই মূলত পিএইচডি গ্রহণের বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে দেশের নন-একাডেমিক পেশাজীবীদের মধ্যেও উচ্চতর এ ডিগ্রির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। বিশেষ করে আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তাদের পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের হার চোখে পড়ার মতো।
বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘পিএইচডিটি গবেষণানির্ভর। এর সংখ্যা বৃদ্ধি দেশের জন্য ইতিবাচক বিষয়। একসময় পিএইচডি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভর হলেও এখন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ ডিগ্রি দিচ্ছে। আমরা যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গবেষণামুখী করি এবং ভালো গবেষক তথা একাডেমিশিয়ানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের পিএইচডির মান আরো অনেক উন্নত করা সম্ভব৷। কারণ পিএইচডির মূল বিষয়ই হলো গবেষণা। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি গবেষণামুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আসবে এবং সুপারভাইজারের কাছ থেকে উপযুক্ত দিকনির্দেশনা পাবে, তখন সে তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভালো মানের কাজ করতে পারবে।’
যদিও দেশে বিভিন্ন সময় পিএইচডি গবেষণা নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে । ২০২১ সালের নভেম্বরে ছয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানায় ঢাকার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়। অনুমোদনহীন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে ভুয়া পিএইচডি সনদ অর্জনের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
বিগত বছরগুলোর মধ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে বেশি পিএইচডি দিয়েছে করোনার বন্ধের মধ্যে ২০২০ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ৬৪১ জন পিএইচডি অর্জন করেছেন। ওই বছর পিএইচডি পেতে চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছিলেন ৮৯০ জন। ২০২১ সালে তা কমে ৩৫৩ জনে দাঁড়ায়।
২০২০ সালে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তার গবেষণা অভিসন্দর্ভের ৯৮ শতাংশই নকল। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে গত বছর পিএইচডি গবেষণায় জালিয়াতি রোধে সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেয়া হয়।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পিএইচডি অর্জন করেছিলেন ২৩৩ জন। ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন ৪০০। ২০১৭ সালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিএইচডি দেয়া হয় ৪৪১ জনকে। এর আগে ২০১৬ সালে ৪৭৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৫২, ২০১৪ সালে ৪৮৮ ও ২০১৩ সালে ৩৭০ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়।
দেশে পিএইচডি প্রদানের দিক থেকে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি ৪৬৪ জন গবেষককে পিএইচডি দিয়েছে। একই সময় পর্যন্ত এমফিল ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ৬৬৬ জন শিক্ষার্থীকে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পিএইচডি হলো জ্ঞান অনুসন্ধান, সৃজন ও সম্প্রসারণের জানালা। দেখতে হবে, এ জানালা দিয়ে নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা। সেটি যদি না হয়, তাহলে অর্ধলাখের জায়গায় দুই লাখ পিএইচডি হলেও এর কোনো উপযোগিতা নেই। বাংলাদেশে পিএইচডির সংখ্যা দেখলে যে কেউ তৃপ্ত হবে এটা ভেবে যে এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এখানে যেসব পিএইচডি হচ্ছে, সেগুলোর উপযোগিতা দেখলে হতাশ হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কিছু বিভাগের জন্মই হয়েছে পিএইচডি দেয়ার জন্য। আমি এমনও দেখেছি, কোনো বিভাগে পাঁচজন শিক্ষক আর ৮০ জন শিক্ষার্থী। এসব ছাত্রের প্রত্যেককে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে থিসিস দেয়া হয়েছে। তার মানে একজন শিক্ষক একই সঙ্গে ১৬টি থিসিস দেখছেন, যা অকল্পনীয়। অনেকেই বলেন, ১০০ জন পিএইচডির মধ্যে যদি ১০ জনও কাজে লাগে, খারাপ কী? কিন্তু যদি কোনোটিই কাজে না লাগে তাহলে সেটি লজ্জার।’
দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ল্যাব ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি বা এমফিল শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকও নেই। কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক ছাড়াই গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ (বিলওয়াবস)। উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানকারী ইনস্টিটিউটটিতে কার্যক্রম চলছে চারজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক দিয়ে। তাদের কারোরই এমফিল বা পিএইচডি নেই। ফলে ইনস্টিটিউটের প্রত্যেক ফেলোকেই সুপারভাইজার ঠিক করে আনতে হচ্ছে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে ইনস্টিটিউট তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
ইউজিসির হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ওই বছর ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৫৩ গবেষককে পিএইচডি দেয়া হয়। বাকি ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয় এ এক বছরে একটিও পিএইচডি প্রদান করতে পারেনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন অনেকে পিএইচডিকে আলংকারিক ডিগ্রি হিসেবেও ব্যবহার করছেন। তাই পিএইচডির সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই গবেষক বৃদ্ধি পাচ্ছে এমনটি নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। যারা পিএইচডি করছেন তারা যদি তাদের এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা করেন, তাহলে অবশ্যই দেশ উপকৃত হবে। কিন্তু কেউ যদি সেটি না করেন তাহলে এই পিএইচডিধারীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রের লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।’