রামসিদ্দি গ্রামে ৩ কোটি টাকার নৌকা বিক্রির আশা

নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়নের রামসিদ্দি গ্রামে নৌকা তৈরি করার ইতিহাস শত বছরের।

নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়নের রামসিদ্দি গ্রামে নৌকা তৈরি করার ইতিহাস শত বছরের। গ্রামটি পরিচিতি লাভ করেছে নৌকা গ্রাম হিসেবে। বর্ষা মৌসুমে প্রতি বুধবার এ গ্রামেই নৌকা বেচাকেনার হাট বসে। হাটের দিন কাক ডাকা ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। 

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ শতাধিক মানুষের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায় গ্রামটিতে। তবে নতুন প্রজন্ম এখন আর পূর্বপুরুষের এ পেশা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। বছরের পর বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এখানে নৌকা কেনাবেচার ধুম পড়লেও এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। চলতি বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় এখনো এ গ্রামে জমে ওঠেনি নৌকার হাট। প্রতি হাটে সারি সারি নৌকা উঠলেও আশানুরূপ কেনাবেচা নেই এখানে। তবু প্রতি হাটে নড়াইল জেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতা আসছেন নৌকা কিনতে। চলতি মৌসুমে এ গ্রাম থেকে অন্তত ৩ কোটি টাকার নৌকা বিক্রির আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

নড়াইল শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রামসিদ্দি গ্রামে গেলে চোখে পড়বে নৌকার কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যস্ততা। এ গ্রামের প্রতিটি পাড়ামহল্লায় রয়েছে নৌকা তৈরির ছোট ছোট কারখানা। সেখানে কাজ করছেন কারিগর ও শ্রমিক। বিভিন্ন গ্রাম থেকে উড়ি আম, পোয়া ও মেহগনি কাঠ সংগ্রহ করে তৈরি করছেন নৌকা। সব মিলিয়ে এ গ্রামে রয়েছে ৫৮টি নৌকা কারখানা। নৌকা তৈরির এ কাজ ঘিরে অন্তত ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

রামসিদ্দি গ্রামে বছরের প্রায় পাঁচ মাস ধরে নৌকার হাট বসে। প্রতি হাটে ১৫০-২০০ নৌকা কেনাবেচা হয়। হাট থেকে নৌকা কিনে ভ্যান, নসিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে নিয়ে যান ক্রেতারা। সরাসরি কারখানা থেকেও নৌকা বিক্রি হয়। চলতি মৌসুমে অন্তত ছয় হাজার নৌকা তৈরির আশা এ গ্রামের কারিগরদের। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অধিকাংশ নৌকাই বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেন ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকরা।

রামসিদ্দি গ্রামের বৃদ্ধ হরশিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘বংশপরম্পরায় ৭০ বছর ধরে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের ছয় মাস নৌকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করি। একসময় আমার বাবা-দাদাও নৌকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এবার বৃষ্টি কম হওয়ার নৌকার চাহিদা অনেক কমেছে। তবু জীবিকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়ে আরো দুজন কারিগর সঙ্গে নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করে যাচ্ছি।’

শ্রমিক জিতেন বিশ্বাস বলেন, ‘প্রত্যেক কারিগর সারা দিনে কাজ করে আয় করেন ৭০০-৮০০ টাকা। আর একজন শ্রমিক পান ৫০০-৬০০ টাকা। এ কাজ করে এখন আর আগের মতো লাভ নেই।’

 কারিগর রতন বিশ্বাস বলেন, ‘খালে-বিলে পানি কমে যাওয়ায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে। এ কাজে এখন আর আগের মতো লাভ নেই। নতুন করে আমাদের উত্তরসূরিরা এ কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। ’

 নৌকা বিক্রেতা নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে সাধারণ ক্রেতা ও ব্যাবসায়ীরা রামসিদ্দি গ্রামে আসেন নৌকা কিনতে। আকার ভেদে প্রতিটি নৌকা বিক্রি হয় ৫-৭ হাজার টাকায়।’

 ব্যবসায়ী তমিজ শেখ বলেন, ‘রামসিদ্দি হাট থেকে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, যশোর, মাগুরাসহ বেশ কয়েকটি জেলার ব্যাবসায়ী ও ক্রেতারা নৌকা কিনে নিয়ে যান।’

 ব্যাবসায়ী লিটন শেখ বলেন, ‘এ হাট থেকে সরাসরি কারিগরদের কাছ থেকে নৌকা কিনে খুলনা ও সাতক্ষীরার বেশ কয়েকটি হাটে আমি নৌকা বিক্রি করি।’

ডহর রামসিদ্দি গ্রামের কৃষ্ণ কালী ও হরি মন্দিরের সভাপতি অমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস জানান, নৌকার হাটটি পরিচালনা করে মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটি। মন্দির কমিটি নৌকা ক্রেতাদের কাছ থেকে হাসিল কেটে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় করে। এ অর্থ মন্দিরে ধর্মীয় কাজ ও এলাকার হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য ব্যয় করা হয়। 

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নড়াইল শাখার উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সুলাইমান হোসেন বলেন, ‘নড়াইলের কারিগরদের তৈরি নৌকার চাহিদা রয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিসিকের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। বিসিক সবসময় কারিগরদের পাশে থাকবে।’

আরও