২০০৯-২০২৪ সাল

প্রশাসন ক্যাডারের অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে

আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাদের একটা অংশ ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা। বিগত সরকারের সময় মাঠ প্রশাসন দলীয়করণের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে তারা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার একটি বড় অংশই আবার চাকরি

আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাদের একটা অংশ ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা। বিগত সরকারের সময় মাঠ প্রশাসন দলীয়করণের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে তারা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার একটি বড় অংশই আবার চাকরি জীবন শেষে সরাসরি যুক্ত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দলটির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদে বসার সুযোগও পেয়ে যান অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করতে যেসব আমলা ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের স্বীকৃতি হিসেবে দলীয় মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে মূলত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে দলটি। অন্যদিকে এর পরিণতি হিসেবে আমলাতন্ত্রসহ সব প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হয় পেশাগত দেউলিয়াপনা। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জামালপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মো. আবুল কালাম আজাদ, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিবও ছিলেন। ১৯৮২ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তাকে পরবর্তী সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয়।

আবুল কালাম আজাদ ২০০৯-১২ সাল পর্যন্ত সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে দুই বছর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সিনিয়র সচিব হিসেবে যোগ দেন। পরের বছরই সেখানে মুখ্য সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পিএমওতে এসডিজি-বিষয়ক সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দেশের বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক চাপ তৈরির জন্য বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে তার ভূমিকাকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়। অনেকে মনে করেন, তার হাত ধরেই দেশের বিদ্যুৎ খাত হয়ে ওঠে বেসরকারি উদ্যোক্তানির্ভর (আইপিপি)।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমির পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক পদেও বসানো হয় তাকে। ড. সাদিক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরকারের শিক্ষা সচিব ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুইডেনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব এবং কাউন্সেলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮২ ব্যাচের এ কর্মকর্তা। এছাড়া ২০১৬ সালের ২ মে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন তিনি। এর আগে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর থেকে কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আবুল কালাম আজাদ ও মোহাম্মদ সাদিক—দুজনই ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নতুন করে যাদের নিয়োগ দিয়েছে, তাদের বেশির ভাগও এসেছেন ওই ব্যাচ থেকেই। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, শুধু আমলাতন্ত্র নয়, আমাদের রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানই দলীয়করণ হয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ যে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, তাদের সময়ই শুধু দলীয়করণ হয়েছে, সেটি বললে চলবে না। অন্য সময়ও হয়েছে। তবে বিগত সরকারের আমলে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ফলে আমলাতন্ত্রসহ সব প্রতিষ্ঠানে পেশাগত দেউলিয়াপনা সৃষ্টি হয়। এগুলো আমাদের দেশে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে।’

প্রশাসন ক্যাডার থেকে আওয়ামী লীগের হাত ধরে সংসদে বসেন সাজ্জাদুল হাসান। ১৯৮৫ ব্যাচের এ কর্মকর্তা ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরি) আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দ্বিতীয়বার সংসদে যান তিনি।

সাজ্জাদুল হাসান ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট বিভাগীয় কমিশনার থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব-১ নিযুক্ত হন। ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি তাকে বসানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের পদে। এরপর ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি হন সিনিয়র সচিব। এ পদ থেকে অবসর নেয়ার পর ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে গিয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তার জন্মস্থান মোহনগঞ্জে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাকে গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। এর কয়েক দিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সংবর্ধনা পান তিনি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের তালিকায় প্রথম সারির দিকে ছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার। ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি চাকরি জীবন থেকে অবসরের প্রায় এক বছর পর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন তিনি। এর আগে অবসরের দুই দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সাবেক কো-চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচটি ইমামের চেয়ারে বসা শুরু করেন। সে সময় গুঞ্জন ওঠে এইচটি ইমামের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন তিনি। 

কবির বিন আনোয়ার দীর্ঘদিন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮৮ ব্যাচের এ কর্মকর্তা উপসচিব হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং অতিরিক্ত সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসরে যান তিনি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ-৩ (বদলগাছি-মহাদেবপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। নির্বাচনের আগে তিনি বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ১৯৮৫ ব্যাচের (সপ্তম ব্যাচ) কর্মকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি ২০২০ সালের ১৮ মে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ তাকে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব করা হয়। এর আগে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৯৩ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি জেলা প্রশাসক হিসেবে খুলনা জেলায় দুই বছর এবং চট্টগ্রাম জেলায় তিন বছর কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালে দেশের ‘‌সেরা জেলা প্রশাসক’ নির্বাচিত হন তিনি। যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। তিনি ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর অবসরে যান তিনি।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়ই সরকারি কর্মকর্তারা রাজনীতিতে যোগ দেন। তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি করা হয় মূলত দলীয় বিবেচনায়। ফলে কর্তৃত্ববাদীদের প্রয়াস থাকে শুরু থেকেই তাদের দলীয়করণের মধ্যে রাখা হয়। কাজেই অবসরের পরই রাজনীতিতে যোগ দেয়ায় বিরাট পরিবর্তন ঘটছে, সেটি আমি মনে করি না। এসব কার্যক্রম প্রশাসন বা আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের দৃষ্টান্ত বটে, কিন্তু এটার থেকেও বড় ক্ষতিকর বিষয় হচ্ছে শুরু থেকে আপাদমস্তক দলীয়করণের বিষয়টা। সেটাই সংকটকে ঘনীভূত করেছে। এটা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে আমাদের।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমলাতন্ত্রসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করে। এটার ফলে তাদের একাংশ সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছে। এভাবেই তারা বেড়ে উঠেছে। একেবারে শুরু থেকেই তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত হন। একই বিবেচনায় পদোন্নতি বদলি ইত্যাদি হয়। যেসব সাবেক আমলা বা পুলিশ কর্মকর্তা প্রশাসনের সহায়তায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর অবস্থায় কর্তৃত্ববাদের অনেক দোসর প্রশাসনের মধ্যেই কর্মরত ছিলেন। কর্মরত থাকা অবস্থায় তাদের অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। বিষয়গুলো এভাবেই দেখা উচিত। প্রশাসনের দলীয়করণ কিংবা আমলাতন্ত্রের দলীয়করণের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে কর্মজীবনের পর রাজনীতিতে যোগদান।’

এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সাবেক আমলাদের মধ্যে খুলনা-১ আসনে সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়, বরগুনা-১ থেকে সাবেক সচিব মিহির কান্তি মজুমদার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। তবে দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের দলীয় আনুগত্য বা দলীয় স্বার্থে কাজ করা আচরণবিধির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই সরকারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেরা সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য কাজ করে গেছেন।’


আরও