বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও এইচএসসি পর্যন্ত। নিয়মিত ক্লাস নিলেও এ শিক্ষকদের একটি বড় অংশই নিজেদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। নিজেদের জ্ঞানের বিষয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস নয় বলেও সম্প্রতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এসব শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যে বিষয়গুলো বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, তা নিজেরা কতটুকু বুঝতে পারেন তারা? সমতল, উপকূল, পাহাড়, হাওর ও চর—সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দেশের ১২টি জেলার ৩৮৪টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পাঠদানকেন্দ্রিক নানা বিষয়ে এ আত্মমূল্যায়ন জানতে চায় নেপের গবেষক দল। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘মিজারিং টিচার ইফেক্টিভনেস ফর প্রাইমারি টিচারস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানেই উঠে এসেছে জ্ঞান নিয়ে অসন্তুষ্টি ও আত্মবিশ্বাসের অভাবের কথা।
প্রতিবেদনে শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত ডিগ্রি ও চাকরির বয়স—এমন কয়েকটি ভাগে শিক্ষকদের আত্মমূল্যায়নের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আত্মমূল্যায়নের ফলাফলকে তিনটি সূচকে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো সন্তুষ্ট, কোনোমতে সন্তুষ্ট ও অসন্তুষ্ট। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, যে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি (মাধ্যমিক) ও এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যায়ের তাদের একটি বড় অংশ নিজেরাই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নন। এ পর্যায়ের ১৮ দশমিক ২ শতাংশ নিজেদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিষয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানান। এছাড়া ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ কোনোমতে সন্তুষ্ট ও ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ সন্তুষ্ট বলে আত্মমূল্যায়নে উঠে এসেছে।
স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিষয়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ অসন্তুষ্ট, ২২ দশমিক ২ শতাংশ কোনোমতে সন্তুষ্ট ও ৭৫ শতাংশ সন্তুষ্ট বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এছাড়া শিক্ষকদের আত্মমূল্যায়ন অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৭ শতাংশ অসন্তুষ্ট, ২৪ দশমিক ১ শতাংশ কোনোমতে সন্তুষ্ট ও ৭৪ দশমিক ১ শতাংশ সন্তুষ্ট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেপের সহকারী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক দলের উপপ্রধান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, শিখন-শেখানো কৌশল, পেশাগত আচরণ, পেশাগত দক্ষতা—এমন নানা বিষয়ে নিজেদের মূল্যায়ন করতে বলা হয় শিক্ষকদের। এক্ষেত্রে একটি সূচকের মাধ্যমে নম্বর দিতে বলা হয়। তাদের দেয়া নম্বরের আলোকে তিন সূচকের মাধ্যমে ফলাফল তুলে ধরা হয়। নির্দিষ্ট মেথডোলজি অনুসরণ করে সন্তুষ্ট, কোনোমতে সন্তুষ্ট ও অসন্তুষ্ট সূচকে বিভিন্ন আত্মমূল্যায়নের ফল তুলে ধরা হয়। গবেষণাপত্রে জরিপে উঠে আসা তথ্যের বাইরে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) প্রকাশিত সর্বশেষ অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেনসাস প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এসব বিদ্যালয়ের পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। ডিপিই প্রকাশিত সর্বশেষ অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাথমিকের শিক্ষকদের ৬ দশমিক ৫ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি, ২৪ দশমিক ৮ শতাংশের এইচএসসি, ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশের স্নাতক ও ৩০ দশমিক ৫ শতাংশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি স্নাতকোত্তর।
বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা থাকলেও তা কাটিয়ে উঠতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পান না শিক্ষকরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০১৯ সালের এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বিদ্যালয়গুলোর বাংলা, গণিত ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও অধিকাংশ শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক শিক্ষক ইংরেজি বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে পাঠদান করছেন। বিজ্ঞান কিংবা গণিতের মৌলিক জ্ঞান ছাড়াই শিক্ষক ক্লাসরুমে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কোনো জিজ্ঞাসা এলে নিজের মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এতে অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ভুল শিখছে। তাই শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক স্পষ্ট জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের তিনটি ভাগে ভাগ করি। খুব বেশি মনোযোগী, মধ্যম পর্যায়ের মনোযোগী ও খুব কম মনোযোগী। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও আকর্ষণীয় বেতনের চাকরিগুলোয় যাচ্ছে। আর সবচেয়ে কম মনোযোগী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকতায় যাচ্ছে। এজন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মাধ্যমিক শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি খুবই জরুরি।’