আগের তিন নির্বাচনের মতোই এবারো জোটবদ্ধভাবেই ভোট করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। বিষয়টি চূড়ন্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে গতকাল জোটনেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন জোট নেতারা। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর আসনের বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। তারা আগের আসনই পাচ্ছেন। আর ঢাকা-৮ থেকে পাস করে সংসদে যাওয়া ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকে বরিশালের একটি আসনে ছাড় দেয়া হচ্ছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ সংবাদ সম্মেলন করবে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকেই ১৪ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে আসছে। তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুটিতে শরিক হিসেবে ছিল জাতীয় পার্টিও। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জনের পর জাতীয় পার্টি জোটে ছিল না। তবে তাদের ছাড় দিয়ে ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। একাদশে আবার জোট করার পর দলটিকে দেয়া হয় ২৬টি আসন, এর মধ্যে তারা জয় পায় ২৩টিতে। বিএনপি এবারো ভোটে না আসায় জোটে ভেড়েনি জাতীয় পার্টি। অবশ্য দলটিকে কোথাও ছাড় দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে।
দ্বাদশ নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা, যা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। তবে কয়টি আসনে শরিকদের ছাড় দেয়া হচ্ছে, সেটি এখনো জানানো হয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আজ বেলা ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন সাধারণ সম্পাদক।
গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। শরিক দলগুলোর মধ্যে ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা; জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার; জেপি সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর আসন বণ্টনের বিষয়টি পুরোপুরি চূড়ান্ত হয়নি। এজন্য চার সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে আসন বণ্টনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর অধিকাংশ শীর্ষ নেতা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে মত দিয়েছেন। এছাড়া দলগুলোর মনোনীত অন্য প্রার্থীরা নিজের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবেন। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া-২ আসনে হাসানুল হক ইনু, পিরোজপুর-২ আসনে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং চট্টগ্রাম-২ আসনে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে জোটের প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে। রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ কিংবা বরিশাল-৩ আসন থেকে জোটের প্রার্থী করা হবে।
বৈঠক প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা জোটগতভাবে নির্বাচনে যাচ্ছি—এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। আসনের বিষয়টি আমির হোসেন আমু ভাই আর ওবায়দুল কাদের বসে ঠিক করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা সবাই মেনেই বৈঠক শেষ করেছি।’
১৪ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জাসদ আসন চেয়েছে আটটি। বর্তমানে দলটির সংসদ সদস্য আছেন দুজন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আসন চায় সাতটি। তাদের সংসদ সদস্য তিনজন। তরিকত ফেডারেশনের বর্তমানে একজন সংসদ সদস্য থাকলেও এবার পাঁচটি আসন আশা করছে দলটি। জেপি পাঁচটি আসন দাবি করলেও বর্তমানে তাদের একজন সংসদ সদস্য। সাম্যবাদী দলের কোনো সংসদ সদস্য না থাকলেও এবার একটি আসন চায় তারা। জোটের বাকি শরিক দলগুলোর বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রত্যাশাও কম নয়।
জানতে চাইলে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটবদ্ধভাবেই আমরা নির্বাচন করব। কিছু কিছু জায়গায় এককভাবেও প্রার্থী দেয়া হবে। তবে আসন বণ্টন প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
একই কথা জানিয়ে শিরিন আখতার বলেন, ‘আমরা জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচন করব। এর বেশি কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা অনেক দল অংশ না নিলেও প্রার্থী হতে অনেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দুটি আসন ছেড়ে ২৯৮ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগও। তবে তারা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাবে—এ কথা নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে জানিয়েছে আগেই। একইভাবে ১৪ দলের শরিক দলগুলোও আলাদাভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে সারা দেশে ২ হাজার ৯৮৫টি মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আর ঋণখেলাপি, দ্বৈত নাগরিকত্ব, পর্যাপ্ত ভোটার সমর্থন না থাকাসহ নানা কারণে ৭৩১টি মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটকে সামনে রেখে বৈধ ঘোষিত প্রার্থীরা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে পারবেন। সেদিনই জানা যাবে, কারা হবেন চূড়ান্ত প্রার্থী। শেষ দিন জোটের প্রধান দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তার নিজের ও শরিকদের নাম পাঠাবে নির্বাচন কমিশনে।
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘আমরা জোটগতভাবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করব। আসনের বিষয়টা নিয়ে আমু ভাই কথা বলে ঠিক করবেন। সমন্বয় করার জন্য আমু ভাই, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বাহাউদ্দিন নাছিমকে দিয়ে টিম গঠন করে দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেসব আসনে এরই মধ্যে প্রার্থী দেয়া হয়েছে তাদের সবাইকে মাঠে থাকার জন্যও বলা হয়েছে। আর যেখানে সমন্বয় দরকার হবে সেখানে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’