ফাঁকা-জনশূন্য-পরিত্যক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিলাসবহুল বাড়ি

দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তারা। এ সময় দ্রুতগতিতে ও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে সম্পদ। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের প্রায় সবাই বসবাস করতেন প্রাসাদোপম ও বিলাসবহুল বাড়িতে। এ বাড়িগুলোই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন নিয়মিতভাবেই এখানে ভিড় করতেন নেতাকর্মীরা। দিন-রাত বাড়িগুলো থাকত জমজমাট।

দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তারা। এ সময় দ্রুতগতিতে ও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে সম্পদ। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের প্রায় সবাই বসবাস করতেন প্রাসাদোপম ও বিলাসবহুল বাড়িতে। এ বাড়িগুলোই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন নিয়মিতভাবেই এখানে ভিড় করতেন নেতাকর্মীরা। দিন-রাত বাড়িগুলো থাকত জমজমাট। নিরাপত্তারও ছিল না কোনো ঘাটতি। কিন্তু দলের পতনের পর হেভিওয়েট নেতাদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে। কেউ কেউ বিভিন্ন মামলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। তাদের বিলাসবহুল বাড়িগুলোও এখন ফাঁকা-জনশূন্য। 

আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী ফেনীর নিজাম উদ্দিন হাজারী। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় গড়েন আলিশান বাগানবাড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে, এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। বাড়ির চারপাশে লেক, হেলিপ্যাড, সুইমিংপুলসহ আয়েশি সব ব্যবস্থা ছিল। এখান থেকেই ফেনীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম হাজারী। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়মিত যাতায়াতের কারণে আলোচিত হয়ে ওঠে বাড়িটি। তবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে জনসাধারণ বাড়িটিতে প্রবেশ করতে পারতেন না।

আওয়ামী লীগের পতনের দিনটিতে এ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন নিজাম হাজারী। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ওইদিন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের অংশ হিসেবে বাড়িটিতে ব্যাপক হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। লুটপাট হয় বাড়ির অভ্যন্তরে থাকা নানা জিনিসপত্র। বিলাসবহুল বাড়িটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এখন পর্যন্ত ওভাবেই পড়ে রয়েছে বাড়িটি।

আওয়ামী লীগের আলোচিত আরেক স্থানীয় হেভিওয়েট নেতা নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী করেছেন। তার স্ত্রী কবিরহাট উপজেলা পরিষদ ও ছেলে সাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। জেলা শহর ছাড়াও নিজ গ্রাম কবিরহাট উপজেলার সোন্দলপুরে গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি। গ্রামের ভেতর হলেও বিশাল আয়তনের একতলা এ ভবনের সামনেই রয়েছে হেলিপ্যাড। বাড়ির সীমানার ভেতরেই রয়েছে বড় পুকুর। বাড়ির পেছনে রয়েছে বিভিন্ন ফলদ ও বনজ বৃক্ষের বাগান।   

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার কারণে একরাম চৌধুরীর গ্রামের বাড়িটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছিল অবাধ পদচারণা। এছাড়া স্ত্রী ও সন্তান উপজেলা চেয়ারম্যান থাকার কারণে সাধারণ মানুষেরও যাতায়াত ছিল বাড়িটিতে। ফলে দিন-রাত সব সময়ই জমজমাট থাকত বাড়িটি। সরকার পতনের আগ পর্যন্তই এমন চিত্র ছিল বাড়িটির। তবে সরকার পতনের পর ভিড় কমলেও কিছু কর্মী-সমর্থক নিয়ে গ্রামের ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন একরাম চৌধুরী। তবে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। পরবর্তী সময়ে গত ১১ আগস্ট পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি ছাড়েন একরাম চৌধুরী। বর্তমানে আলিশান বাড়িটি ফাঁকা ও জনশূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

কূটনৈতিকপাড়া খ্যাত গুলশান-২-এর ৭১ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটিতে বসবাস করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঢাকা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সালমান ফজলুর রহমান। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী এমনকি বিদেশী কূটনীতিকদেরও নিয়মিত আনাগোনা ছিল এখানে। গুলশানের তিনতলা বাড়িটি ছিল রাজধানী ঢাকার অন্যতম বিলাসবহুল বাড়ি, যার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল কঠোর। এ বাড়িজুড়ে এখন শুধু নীরবতা আর পোড়া গন্ধ। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই বাড়িটিতে ঢুকে লুটপাট চালানো হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়ির প্রাঙ্গণে ও গ্যারেজে থাকা ১২টি গাড়ি। দ্বিতীয় তলায়ও আগুন লাগানো হয়। বর্তমানে এটি একপ্রকার পোড়ো বাড়ি হিসেবে পড়ে আছে। 

রাজধানীর বনানীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার বাড়ির অবস্থান। সরকার পতনের পর বাড়িটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ বাড়িটিও এখন ফাঁকা পড়ে আছে। 

আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন নিজের নির্বাচনী এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। ভাঙার আজিমনগর ইউনিয়নের চরচন্দ্রা গ্রামের কয়েক একর নিয়ে গড়ে তোলা বাড়িটিতে বিলাসী জীবনযাপনের প্রায় সব উপকরণ রয়েছে। দোতলা বাড়িটিতে পুকুর, ছোট মাঠ, ফলের বাগান তৈরি করা হয়েছে। নেতাকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা। নির্বাচনী এলাকায় নিক্সনের কর্মসূচি থাকলে এখানেই থাকতেন তিনি। নিক্সনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীরা ওই বাড়িতেই ভিড় জমাতেন। তবে নিক্সনের অনুপস্থিতিতে বাড়িটিতে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ছিল সীমিত। সরকার পতনের পর এ বাড়িটিও একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়েছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ নানা কারণে সমালোচিত নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল। নাটোর শহরের কান্দিভিটা মহল্লায় গড়ে তুলেছিলেন বিলাসবহুল জান্নাতি প্যালেস। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাড়িটি ছিল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। পুরো বাড়ির আশপাশ ছিল সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি বড় সময়ে এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হতো নাটোরের ঠিকদারি কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রীড়াঙ্গন। নাটোরে বিভক্ত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনেও এমপি শিমুলের সমর্থকদের অংশটির কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। ফলে নাটোরের রাজনীতিতে আলোচিত এক নাম হয়ে উঠেছিল জান্নাতি প্যালেস।

সরকার পতনের পর বাড়িটিতে ব্যাপক হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনার পতনের সময়ে বাড়িটিতে শিমুলের আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিলেন না। সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কর্মচারীরাও এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। স্থানীয়রা জানান, পরিবারের সদস্যরা কানাডায় থাকেন। শিমুল নাটোরে থাকলে এ বাড়িতেই থাকতেন। স্বজনরা তার দেখাশোনা বা খোঁজখবর নিতেন। তিনি নাটোরে অবস্থানকালে এ বাড়িতেই থাকতেন। সে সময় গভীর রাত পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকের আনাগোনা থাকত। এ বাড়িও এখন পরিত্যক্ত জনশূন্য। 

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের–(সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমার জানামতে পতনের পর কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের এভাবে পালিয়ে যাওয়ার নজির নেই। শুধু তা-ই নয়, ওই দলটির নেতাকর্মীদেরও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এত বছর ধরে তারা যে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, সেগুলোও তারা ভোগ করতে পারছে না। বাড়ি-ঘরে থাকতে পারছে না। তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কারণেই তাদের এ করুণ পরিণতি। তাই একমাত্র গণতান্ত্রিক চর্চা আর মানুষের আস্থাই পারবে ভবিষ্যতে সরকারগুলোকে এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে।’

আওয়ামী লীগ শাসনামলে খুলনায় ‘‌ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হয়ে উঠেছিল মহানগরীর শেরেবাংলা রোডে অবস্থিত ‘‌শেখ বাড়ি’। পৈতৃক সূত্রে দোতলা ও বিলাসবহুল এ বাড়ির মালিক ছিলেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন,  খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বাবু। সরকার পতনের দিনই বাড়িটিতে দফায় দফায় ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও বাড়ির মালামাল লুট হয়ে যায়। বর্তমানে বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপ।

সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ঢাকায় থাকতেন। তার ভাই সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বাবু কখনো ঢাকায় কখনো খুলনার বাড়িতে থাকতেন। তারা বাড়িতে থাকলে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ি থাকত খুলনার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকে লোকারণ্য। সেই বাড়ি এখন পুরোপুরি জনশূন্য।  

সরকার পতনের পর পলাতক অবস্থায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। রাজধানী ঢাকা এবং স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি করা বাড়িতে নেই বেশির ভাগ নেতা। শেখ হাসিনার ফুপা আমির হোসেন আমুর ঢাকার ইস্কাটনের বাসভবন ও ঝালকাঠি শহরের রোললেস সড়কের বাসভবন ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরে শহরের সদর হাসপাতাল সংলগ্ন সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিমের বাসভবনও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আছে।  

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার কারণে কর্তৃত্ববাদের সৃষ্টি। এ ব্যবস্থা তৈরিতে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও পালাতে হয়েছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। সেসব বাড়িতে এখন থাকার মতো কেউ নেই। আবার তাদের অনেকে বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার করেছেন। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তা দেশের প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে পাচারের গন্তব্য দেশের সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আইনি সমঝোতা করতে হবে।’

আরও