দেশে প্রতি বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয় সাধারণত মে থেকে জুনে, যা অক্টোবরে এসে কমে যায়। এবার তার উল্টো চিত্র। অক্টোবরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩০ হাজার ৮৭৯ রোগী, যা এ বছরে সর্বোচ্চ। এর আগের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে যায় যথাক্রমে ৬ হাজার ৫২১ ও ১৮ হাজার ৯৭ রোগী। সে হিসাবে দুই মাসের ব্যবধানে ভাইরাস জ্বরটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। অক্টোবরে মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল সর্বোচ্চ, ১৩৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেয়া তথ্য থেকে এসব জানা যায়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা নভেম্বরে আরো বাড়ছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এ রোগ নিয়ে ১ হাজার ৩৭০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। চলতি বছরে একদিনে এখন পর্যন্ত ভর্তি হওয়া সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা এটি। এর আগে গত রোববার একদিনে ১ হাজার ৩০৬ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তির তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয় ৬৭ হাজার ১৩৮ ডেঙ্গু রোগী। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে আরো ছয়জনের। এ নিয়ে চলতি বছর জ্বরটিতে প্রাণ হারিয়েছে ৩২৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ২০২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৮৯৭ জন, বাকি ২ হাজার ৩০৫ জন ভর্তি আছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগের হাসপাতালে। আর ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হওয়া ছয়জনের মধ্যে দুজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এবং একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা। মৃতদের মধ্যে একজন করে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের (রাজধানীর বাইরের)।
বিগত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণত মে-জুনে বিশেষ করে বর্ষায় প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এ বছর শুরু হয়েছে জুলাই-আগস্টে। প্রকৃতিতে এখন শীতের আগমনী বার্তা। এর মধ্যেই হু হু করে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় জ্বর হলেই আক্রান্তরা ডেঙ্গু শনাক্তে ভিড় করছে হাসপাতালে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো জ্বর নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর। তখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৭৯ হাজার ৯৯৪ জন। এছাড়া ২০২৩ সালের আগস্টে ৭২ হাজার ৩৭৮ ও অক্টোবরে হাসপাতালে যেতে হয় ৬৮ হাজার ১২৮ জনকে। চলতি বছরের আগস্টে অবশ্য আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৫২১, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭ ও অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরে আগের দুই মাসের তুলনায় আক্রান্ত কমলেও চলতি বছরের একই সময় প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তন অসময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর সংখ্যা বাড়া কিংবা কমা নির্ভর করে প্রাকৃতিক কারণে। এ বছর বৃষ্টির ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন কার্তিক মাস, তবু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে এডিস মশা বাড়তে পারে। আবার উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা থাকলে এডিস মশার কামড়ানোর স্পৃহা বেড়ে যায়। এসব কারণেই হয়তো এ সময়ে ডেঙ্গু বেশি ছড়াচ্ছে।’
দেশে ডেঙ্গুর পাদুর্ভাব বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জনসাধারণের মাঝে সচেতনতার অভাব রয়েছে। গণমানুষকে সচেতন করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া উচিত। প্রচারমাধ্যমগুলোও সচেতনতা বাড়াতে খুব বেশি উদ্যোগী নয়। এছাড়া সরকারের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট খাতে দুর্নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব দিকে নজর দেয়া উচিত।’