মৌসুম শুরুর আগেই ক্ষতির মুখে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন খাত

পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। তবে তার আগেই বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্প।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। তবে তার আগেই বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্প। জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেও পাহাড়ে পর্যটকদের আনাগোনা ছিল। মাসের মধ্যবর্তী সময়ে পরিস্থিতি উত্তাল হলে পর্যটকশূন্য হয়ে যায়। সেই ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেননি খাতসংশ্লিষ্টরা। চলমান পরিস্থিতিতে পাহাড়ে পর্যটক আগমন একেবারেই কমে গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের চলমান পরিস্থিতির সমাধান না হলে পাহাড়ের অর্থনৈতিক অন্যতম খাত পর্যটন শিল্প বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

রাঙ্গামাটির হোটেল-মোটেল কটেজ-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা জানান, তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনে অর্থনৈতিক বড় খাত হোটেল-মোটেল, কটেজ-রিসোর্ট। জেলার সবচেয়ে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মেঘ পাহাড়ের উপত্যকা বাঘাইছড়ি সাজেক ভ্যালি। সেখানে পর্যটক নেই বললেই চলে। নিরাপত্তাহীনতায় পর্যটক কমে গেছে খোদ রাঙ্গামাটি বিনোদন কেন্দ্রগুলোয়। একই অবস্থার কথা জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের হোটেল-মালিকরাও।

প্রায় চারদিকে কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত রাঙ্গামাটির কোনায় কোনায় রয়েছে বিভিন্ন পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র। শহরের এসব পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে যাতায়াতে পর্যটক এবং স্থানীয়রা যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করেন। পর্যটক না থাকায় আসামবস্তি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কসহ শহরে চলাচলরত অটোরিকশার যাত্রীও কমেছে। কাপ্তাই হ্রদেও পর্যটকের দেখা মিলছে না। অলস সময় পার করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। ট্যুরিস্ট বোট খাতে নিয়োজিত মালিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দেখা দিয়েছে।

রাঙ্গামাটির পর্যটন বোট ঘাটের ব্যবস্থাপক ও ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সহসভাপতি মো. রমজান আলী বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদে চলাচলকারী ট্যুরিস্ট বোটের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিক-কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। কাপ্তাই হ্রদে চলাচলকারী আমাদের ১২০টির অধিক ট্যুরিস্ট বোট রয়েছে; মালিক-শ্রমিক মিলিয়ে আছেন ২০০ জন। দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটকশূন্যতায় পেশার করুণ দশা।’

তিন পার্বত্য জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম বলা হয় সাজেক ভ্যালি উপত্যকাকে। ভৌগোলিক ও প্রকৃতিগতভাবে সাজেক রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে অবস্থিত হলেও যাতায়াত ও পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক খাতে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত খাগড়াছড়ি জেলার উদ্যোক্তারা। সাজেকের পর্যটনে ভাটার প্রভাব পড়েছে খাগড়াছড়ির চাঁন্দের গাড়ি হিসেবে পরিচিত জিপচালক-শ্রমিকদের ওপর। পর্যটক কমে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছে পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা। অন্য সময় ব্যক্তিগত গাড়ি ও জিপসহ শতাধিক যানবাহন খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বর থেকে সাজেকের উদ্দেশে ছেড়ে এলেও এখন গড়ে পাঁচটি গাড়ি চলছে।

সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল চাকমা জন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিন-চার মাস ধরে সাজেকের পর্যটন ব্যবসায়ীদের দুর্দিন যাচ্ছে। দেশের চলমান অবস্থায় সাজেক পর্যটকশূন্য বলা চলে। এত বড় পর্যটন কেন্দ্রে ২০-২৫ পর্যটক কিছুই না। কটেজ মালিক সমিতির অধীনে সাজেকে ১১৬টি কটেজ-রিসোর্ট রয়েছে। এসব কটেজ-রিসোর্ট মালিকদের অনেকেই ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। পর্যটক না থাকলেও কটেজ ভাড়া, স্টাফের মজুরি, পানিসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করতে হচ্ছে। পর্যটক না থাকায় সাজেকের খাবার দোকান, যানবাহন ও পর্যটকবাহী পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্পে প্রতীক হিসেবে পরিচিতি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্মিত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু। জুলাইজুড়ে ঝুলন্ত সেতুটি ভ্রমণে পর্যটকদের উপস্থিতি কমে গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় পর্যটকসহ গড়ে ১০০-১৫০ টিকিটের বেশি বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা।

তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পর্যটন ঝুলন্ত সেতুতে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ মানুষ টিকিট কেটে ভ্রমণ করছেন। এর মধ্যে স্থানীয়রাও রয়েছেন। আমাদের হোটেল-মোটেল ভাড়াও আশঙ্কাজনক কমে গেছে। আমাদের বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৮৫টি রুম থাকলেও প্রতিদিন গড়ে ভাড়া হচ্ছে তিন-চারটি। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম। মৌসুমের আগের এ সময়েই পর্যটক নেই। তবে নির্বিঘ্নে যানবাহন চলাচল শুরু হলে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা সংকট কাটলে মৌসুম শুরুর আগেই সংকট কেটে যাবে।’

রাঙ্গামাটি আবাসিক হোটেল মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘সমিতির অন্তর্ভুক্ত হোটেল বোর্ডিং রয়েছে ৫৩টি। সমিতির বাইরেও অন্যান্য রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। দেশের চলমান অবস্থাকে কেন্দ্র রাঙ্গামাটিতে পর্যটক না আসায় কার্যত বেশির ভাগ হোটেলই বন্ধ রয়েছে। পর্যটক থাকলে সব মিলিয়ে দৈনিক ২০-২৫ লাখ টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে। তবে এখন সেটা হচ্ছে না।’

বর্তমান সময়ে পাহাড়ের পর্যটন শিল্পকে অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. আব্দুল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে প্রধান বলা চলে পর্যটন খাতকে। কিন্তু বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে পর্যটক নেই বললেই চলে। এখানকার হোটেল-মোটেল, অভ্যন্তরীণ যানবাহন, ট্যুরিস্ট বোটসহ খাতসংশ্লিষ্টরা সবাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

আরও