বাংলাদেশ থেকে একক দেশ হিসেবে রফতানীকৃত পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগও (এফডিআই) সবচেয়ে বেশি এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় ধরনের টানাপড়েন দেখা দেয়। বিশেষ করে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অস্বস্তি বেড়ে যায়। তবে এসব টানাপড়েনের মধ্যেও বিগত বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক নানা ক্ষেত্রে বড় হয়েছে। এফডিআইর উৎস ও রফতানি গন্তব্য হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সেরও অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে দেশটি।
আজই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্কে এ নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব খুব একটা বড় হবে না বলে মনে করছেন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্যের বিশ্লেষকরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কিছু টানাপড়েন দেখা দিলেও অতীতে বরাবরই বাংলাদেশের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে শীর্ষ সহায়তাকারী দেশগুলোর অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতায়ন শুরু হয়েছিল মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরইসিএ) সহযোগিতায়। সংস্থাটির ১৯৭৬ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষার প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), যা গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতায়নের এক সফল মডেলের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এছাড়া দেশের জ্বালানি খাতেও বড় অবদান রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। জাতীয় গ্রিডে স্থানীয়ভাবে সরবরাহকৃত গ্যাসের প্রায় ৩৪ শতাংশই আসছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হয় ১৯৮৯ সালে। এ চুক্তি সম্পাদনের পর দেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সমান সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকে মার্কিন কোম্পানিগুলো। দেশটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধানতম উৎস ও শীর্ষ রফতানি গন্তব্য।
কিন্তু এ অর্থনৈতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয় ২০২১ সালের শেষ দিকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এর কয়েক কর্মকর্তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। দুই দেশের সম্পর্কে দেখা দেয় টানাপড়েন, যা চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আরো তীব্রতা পায়। এর মধ্যেই আবার বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার অভিযোগ তুলে ২০২৩ সালে আরো কয়েক ব্যক্তিকে মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হয়। সর্বশেষ সাবেক এক সেনাপ্রধান ও তার পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে বিগত শেখ হাসিনা প্রশাসনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অস্বস্তি বেড়ে যায়।
এ অস্বস্তির মধ্যেও দেশের রফতানি গন্তব্য হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রাখে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে ৯৮০ কোটি ১৭ লাখ ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে ১৬৯ কোটি ৮ লাখ ডলারের, যা মোট রফতানির ১৭ শতাংশেরও বেশি। একক গন্তব্য দেশ হিসেবে এ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি রফতানি করেছে বাংলাদেশ। দেশটিতে প্রধানত তৈরি পোশাক, মৎস্য, হোম টেক্সটাইল, কাঁচা পাট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও হস্তশিল্পজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ।
আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৩৭ কোটি ৮২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সময়ে দেশটি বাংলাদেশে পণ্য রফতানি করেছে ১৩৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। এর আগে ২০২৩ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করেছে ৮৩০ কোটি ডলারের। রফতানি করেছে ২৩০ কোটি ডলারের।
এখনো বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের শীর্ষ উৎস যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে দেশে পুঞ্জীভূত মোট বিদেশী বিনিয়োগের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই এসেছে দেশটি থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষ শেষে দেশে নিট পুঞ্জীভূত এফডিআই বা নিট এফডিআই স্টক ছিল প্রায় ২ হাজার ৫৪ কোটি ৯১ লাখ ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এফডিআই স্টক ছিল প্রায় ৩৯৩ কোটি ৫৪ লাখ ডলার।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের অন্যতম শীর্ষ উৎস হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ডলারের, যা এ সময় মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় ১৬ শতাংশ।
সর্বশেষ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের সংস্কার ও পুনর্গঠন কার্যক্রমে অংশীদার হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলার উন্নয়ন সহযোগিতা দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)।
অভিবাসন ও রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের অন্য কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেগুলোর প্রভাব মূলত যুক্তরাষ্ট্রে বৃহদায়তনে রফতানি করা দেশের ওপরই পড়বে। দেশটির মোট আমদানিতে বাংলাদেশের অবদান খুবই যৎসামান্য। সে হিসেবে তার বাণিজ্যসংক্রান্ত পদক্ষেপগুলোয় বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে মার্কিন প্রশাসন দেশটি থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠানোর ওপর কর আরোপ করলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে এর প্রভাব পড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক আমদানি ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর। সে হিসেবে আমাদের আমদানি-রফতানি খুব একটা হিসাবের মধ্যে আসে না। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা কমলা হ্যারিস যে-ই জিতুক না কেন, আমাদের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি বিশ্বাস করি না। ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভের পর ট্যারিফ আরোপ করলে এর প্রভাব পড়বে ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় দেশগুলোয়। তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমরা নই। তবে ট্রাম্প যা বলেছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করলে আমাদের অভিবাসনে প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশের অনেকেই সেখানে আনডকুমেন্টেড অবস্থায় অবস্থান করছেন। তাদের বিপদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে সব দেশের ওপর রেমিট্যান্সে ট্যাক্স আরোপ করলে আমাদের ওপরও প্রভাব পড়বে। প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের এখানে আসে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণের উৎসের তালিকায় দেশটির অবস্থান এখন শীর্ষে।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধির কিছুটা লক্ষণ দেখা দিলেও নতুন করে আশঙ্কা তৈরি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য। সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন বক্তব্যে বিগত সরকার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশ নিয়ে দেশটির অবস্থানে আবারো পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করতে থাকেন অনেকে। যদিও অনেকে এ বক্তব্যকে স্রেফ রাজনৈতিক মন্তব্য হিসেবেই দেখছেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কে নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব খুবই সামান্য হবে বলে মনে করছেন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানও।
প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ তার ফেসবুক পেজে গতকাল লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের ওপর মার্কিন নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলছে। কোনো সন্দেহ নেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব এবং মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনে যে পক্ষই জয়লাভ করুক, মার্কিন নীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে সেলফি বা আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থার ছবি থেকে মৌলিক পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে দেখার বিষয়টি একেবারেই শিশুসুলভ। এসব নীতি সাধারণত মোটাদাগে স্বাধীন একটি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারণ হয়। বৃহদায়তনে নীতিগত কিছু পরিবর্তন দেখা দিলেও তা নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। আর বিচক্ষণ যেকোনো নীতিকৌশলেই বাংলাদেশ হলো এশিয়ার মধ্যকার একটি দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিরোধ রয়েছে। আর ভারতের গুরুত্ব শুধু চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে। তবে আমি মনে করি, উভয় পক্ষই সংঘাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। যে পক্ষই জিতুক মূল ইস্যু হবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ন্যাটোকে শক্তিশালী করা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে ট্রান্স-আটলান্টিক অর্থনীতি বিচক্ষণ যেকোনো মার্কিন প্রশাসনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।’