রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ৯০% রোগীই সীমান্ত এলাকার

দেশে মশাবাহিত যে কয়টি রোগ রয়েছে এর মধ্যে একটি ম্যালেরিয়া।

দেশে মশাবাহিত যে কয়টি রোগ রয়েছে এর মধ্যে একটি ম্যালেরিয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা ম্যালেরিয়ার ‘রেড জোন’ বা ‘হট স্পট’ হিসেবে পরিচিত। তবে বিগত কয়েক বছরে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা না গেলেও মৃত্যুহার শূন্যে নেমে এসেছে। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৭-২৩ সাল পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি।

জেলার ভারত সীমান্তবর্তী চারটি উপজেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালে সীমান্তবর্তী বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় জেলার মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের ৭৫ শতাংশ রোগী পাওয়া গেলেও এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। ঘন বন, গহিন জঙ্গল ও দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে এ চারটি উপজেলায় বাড়ছে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি। সম্প্রতি জেলা সিভিল সার্জন (সিএস) অফিসের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এ চিত্র।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে হলে প্রথমত ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জীবাণু ও বাহক ধ্বংস করতে হবে। জীবাণু ধ্বংস করা সম্ভব হলে মশা কামড়ালেও ম্যালেরিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। আবার জীবাণু ধ্বংস না হলেও যদি মশার বিস্তার ধ্বংস করা যায় সেক্ষেত্রে বাহকের অভাবে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর সুযোগ থাকবে না। তবে মশা নির্মূল করা না গেলেও শহুরাঞ্চলে মশার জীবাণু ধ্বংস কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অনেকটা কমে এসেছে রাঙ্গামাটি শহরে। তবে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়ায় জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলাগুলোয় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের হার কমলেও দুর্গম ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।

জেলা সিভিল সার্জন অফিসের ম্যালেরিয়াবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০২ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর পাহাড়ি এ জেলায় ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে মৃত্যুহার। সর্বশেষ ২০১৬ সালে রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হলেও বিগত সাত বছর মৃত্যুশূন্য রয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্যে দেখা গেছে, ২০০২ সালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৩ সালে ১১৯, ২০০৪ সালে ১০৪, ২০০৫ সালে ৯৬, ২০০৬ সালে ৭৫, ২০০৭ সালে ৫২, ২০০৮ সালে ২৪, ২০০৯ সালে ১২, ২০১০ সালে ১০, ২০১১ সালে ৫, ২০১২ সালে ১, ২০১৩ সালে দুজনের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৪ ও ১৫ সালে ম্যালেরিয়ায় কারো মৃত্যু হয়নি। ২০১৬ সালে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে ২৩ সাল পর্যন্ত অনেকে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয়নি কারো।

আক্রান্তের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটির ১০ উপজেলায় মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী ছিল ৮ হাজার ২৮৭ জন। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী চার উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল ও বাঘাইছড়িতেই ছিল ৬ হাজার ১৮৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৭৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে জেলায় মোট আক্রান্ত রোগী ছিল ৩ হাজার ১৩ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় ছিল ২ হাজার ৫৯২ জন; যা মোট আক্রান্তের ৮৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৬৬ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় ছিল ৫ হাজার ৩৫৮ জন; যা মোট আক্রান্তের ৮৮ শতাংশ। ২০২০ সালে জেলায় আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৩৯০ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় ছিল ১ হাজার ২০৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৮৭ শতাংশ। ২০২১ সালে জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৫৪ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় ছিল ১ হাজার ৪১০ জন; যা মোট আক্রান্তের ৯১ শতাংশ। ২০২২ সালে জেলায় আক্রান্ত হয়েছিল ৩ হাজার ২১৯ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় ছিল ২ হাজার ৮৮৪ জন; যা মোট আক্রান্তের ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালে জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৯৭ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৯০ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত পুরো জেলার ২ হাজার ৬৯৭ জন ম্যালেরিয়া রোগীর মধ্যে জুরাছড়িতে ১ হাজার ৯১, বিলাইছড়িতে ৫০৬, বরকলে ৪৫৬ এবং বাঘাইছড়িতে ৩৯৬ জন। বাকি ২৪৮ রোগী অন্য ছয়টি উপজেলায় পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল-পরবর্তী রাঙ্গামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের হার ওঠানামা করলেও সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় এ হার ঊর্ধ্বমুখী।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে ৯ হাজার ২২৬ ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে। সংখ্যাগত দিক দিয়ে ৬০ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে বান্দরবানে। যার মোট সংখ্যা ৫ হাজার ৫৩৪ জন। অন্যদিকে ২ হাজার ৬৯৭ রোগী পাওয়া গেছে বান্দরবানে, যা শতকরা হিসাবে ২৯ শতাংশ। খাগড়াছড়িতে পাওয়া গেছে ২৩৮ জন।

এর মধ্যে সারা দেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ১২৯ জন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর মধ্যে মারা গেছে চারজন; তাদের দুজন বান্দরবান জেলার। বান্দরবানের ৬০ জন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর মধ্যে দুজন মারা গেলেও রাঙ্গামাটির ১১ ও খাগড়াছড়ি ১৮ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রোগী সুস্থ হয়েছেন। মারা যায়নি কেউ।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির রাঙ্গামাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার ডা. এন্ড্রু বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাঙ্গামাটি জেলায় বর্তমানে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শূন্যতে নেমে এসেছে। ২০১৭ সালের পর থেকে রাঙ্গামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। তবে রাঙ্গামাটির ভারত সীমান্তবর্তী যে চারটি উপজেলা রয়েছে; সেগুলোয় আক্রান্ত হার তুলনামূলক বাড়ছে। সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়িতে ২০১৭ সালে ৭৫ শতাংশ রোগী পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে ৯০ শতাংশ। বিগত বছরগুলোয় রাঙ্গামাটি জেলায় সামগ্রিকভাবে ম্যালেরিয়ার উন্নতি হলেও সীমান্তবর্তী এলাকায় ঝুঁকি বেড়েছে।’

এর কারণ উল্লেখ করে ডা. এন্ড্রু বিশ্বাস বলেন, ‘দেখা গেছে রাঙ্গামাটি ম্যালেরিয়া নির্মূল কার্যক্রমের চেয়ে সীমান্তের ওপারে কার্যক্রম অনেকাংশে কম। সীমান্তবর্তী ওইসব এলাকায় ওপারের মশাও এপারে আসে। আবার সীমান্ত খোলা হওয়ার কারণে অনেক সময় মানুষ যাতায়াত করে। অন্যদিকে সীমান্তবর্তী এসব এলাকা ঘন বন, গহিন জঙ্গল ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে মশার বিস্তার বেড়ে চলেছে। রাতের বেলায় অনেকেই মশারি ব্যবহারের ফলে মশা কামড়াতে পারছে না। তবে স্থানীয় অধিবাসীরা দিনের বেলায় যখন বনে কাঠ কাটতে কিংবা অন্যান্য কাজে যায় সেখান থেকে তারা আক্রান্ত হয়। বলা যায় মশা অনেকটা স্বভাব পরিবর্তনের ফলেও সীমান্তবর্তী এলাকায় ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।’

মৃত্যুশূন্য হওয়া প্রসঙ্গে এ চিকিৎসক বলেন, ‘ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হলেও সব রোগী ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পড়ে না। অনেক ক্রিটিক্যাল রোগী পাওয়া গেলে আমরা সেসব রোগী নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছি। আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে তার শরীরের জীবাণু ধ্বংস হওয়ার ফলে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।’

রাঙ্গামাটির সিভিল সার্জন (সিএস) ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী বলেন, ‘বিগত বছরগুলোয় রাঙ্গামাটি জেলায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু শূন্যে নেমেছে। কিন্তু জেলার সঙ্গে ভারত ও মিয়ানামার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এর একমাত্র কারণ আমাদের প্রতিবেশী দেশে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম নেই। সীমান্তবর্তী এলাকার দুই পাশের মানুষের অবাধ যাতায়াত ও জীবাণু বাহক মশার বিচরণের কারণে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ বেশি। আবার এসব সীমান্তবর্তী উপজেলার দুর্গম ইউনিয়নগুলোয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কার্যক্রম পরিচালনাও অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। জুরাছড়ির দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নসহ ম্যালেরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ অনেক এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরাও সহজে পৌঁছাতে পারেন না।’

আরও