যোগাযোগ অবকাঠামো খাত

উচ্চ ব্যয়ের বেশির ভাগ প্রকল্পে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হয়নি

রাজধানীর দ্বিতীয় দ্রুতগতির উড়াল সড়ক ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়কটির নির্মাণ ব্যয় ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। চীনের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জিটুজি পদ্ধতিতে। অন্যান্য জিটুজি প্রকল্পের মতো এটিতেও ঠিকাদার নিয়োগে কোনো দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। চীন ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমঝোতার ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে চীনের

রাজধানীর দ্বিতীয় দ্রুতগতির উড়াল সড়ক ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়কটির নির্মাণ ব্যয় ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। চীনের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জিটুজি পদ্ধতিতে। অন্যান্য জিটুজি প্রকল্পের মতো এটিতেও ঠিকাদার নিয়োগে কোনো দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। চীন ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমঝোতার ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি করপোরেশনকে (সিএমসি) নিযুক্ত করেছে।

জিটুজি পদ্ধতিতে এভাবে ঠিকাদার নিয়োগ না করে তা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয় অনেকটাই কমে যেত বলে মনে করছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব) পদ্ধতিতে সমজাতীয় ও প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। অথচ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হচ্ছে এর প্রায় দ্বিগুণ। 

শুধু উচ্চ ব্যয় নয়, কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে বড় অংকের কমিশনের কারণেও আলোচনায় এসেছে আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। প্রকল্পটি পরিকল্পনাধীন অবস্থায়ই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি বাংলাদেশের এপিক সলিউশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, এপিক সলিউশন কাজটি পাইয়ে দিতে সিএমসিকে সহযোগিতা করবে। বিনিময়ে কাজের চুক্তি মূল্যের ৬ শতাংশ কমিশন পাবে এপিক সলিউশন, যা প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ। সম্প্রতি চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে প্রতিষ্ঠান দুটি আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। জিটুজি পদ্ধতির এ ধরনের চুক্তিকে ‘‌অনৈতিক’ ও ‘‌নজিরবিহীন’ বলে অভিহিত করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, শুধু আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে নয়, দেশের প্রায় সব প্রকল্পে এমন দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান কমিশন বাণিজ্য হয়ে আসছে। এ কমিশনের সুবিধাভোগী প্রকল্পের কর্মকর্তা থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা ও রাজনীতিবিদ। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ দেয়া হলে এ ব্যয় কমে আসত। তাছাড়া এখানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে জিটুজি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তা-ও বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অনেকাংশেই অনুপযোগী।

বিষয়টি সম্পর্কে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বাংলাদেশে বড় প্রকল্পগুলোয় সরকারের পরিকল্পনা কমিশন থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে একটা অদৃশ্য কমিশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে বলে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদেরও বিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অদৃশ্য কমিশনকেও অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীরা হিসাবে নেয়, যা কার্যত প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। আশপাশের যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা রেল প্রকল্প হোক বা সড়ক নির্মাণ; আমরা দেখি বাংলাদেশে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ বা তারও বেশি। এমনকি ইউরোপের দেশগুলোর চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ ধরনের অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি।’

তিনি বলেন, ‘যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ বা কেনাকাটায় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হলে যুক্তিসংগত দামে কাজ করা যায়। যদিও জিটুজি প্রকল্পে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের কোনো সুযোগ থাকে না। উল্টো এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঋণদাতা দেশ নানা শর্ত জুড়ে ব্যয় বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। শুধু ঠিকাদার না, পরামর্শক, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী—প্রায় সবকিছু অনেকটা জোর করে ঋণদাতা দেশ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এতে একদিকে যেমন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়, তেমনি বাংলাদেশের ঠিকাদার, পরামর্শক, প্রকৌশলীদের কাজের সুযোগও কমে আসে। সামগ্রিকভাবে আমি বলব, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জিটুজি প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি।’

জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশের আরেকটি বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। জিটুজি হওয়ায় প্রকল্পেও ঠিকাদার নিয়োগে কোনো দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়নি। ‌সমঝোতার ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)। টাকার অংকে প্রকল্পটি দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। বাংলাদেশী মুদ্রায় এতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণ ব্যয় ২৩০ কোটি টাকার বেশি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন রেলপথ (নন-আরবান হেভি রেল প্রজেক্ট) প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল।

জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত আরেক প্রকল্প হলো কর্ণফুলী টানেল। টানেলটির নির্মাণ ব্যয় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার  বেশি। এ প্রকল্পেও ঋণদাতা চীন। এখানেও কোনো দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। সমঝোতার ভিত্তিতে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। 

দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে জিটুজি পদ্ধতি ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। অনেকগুলোর কাজ এখনো চলমান। এসব প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও প্রক্রিয়াটিকে প্রতিযোগিতামূলক হিসেবে মানতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা। 

বুয়েটের আরেক অধ্যাপক ড. সামছুল হক জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‌‌জাইকা বাংলাদেশে মেট্রোরেল, রেল সেতুসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে তারাই আবার পরামর্শক হিসেবে থেকেছে। পরামর্শক হিসেবে তারা প্রতিটি প্রকল্পের নকশা ও ব্যয় প্রাক্কলন করে দিয়েছে। দরপত্রের কাগজপত্রও তারা তৈরি করে দিয়েছে। বেশির ভাগ প্রকল্পে দেখা গেছে, আহ্বান করা দরপত্রে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, কেবল জাইকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই যার সুবিধাভোগী। ফলে দেখা যায়, ওই স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই শেষমেশ কাজটি পেয়ে যায়। দিনশেষে দরপত্র প্রক্রিয়াটি কতটা প্রতিযোগিতামূলক হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’

জাইকার অর্থায়নে বর্তমানে ঢাকার এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১ ও এমআরটি লাইন-৫, নর্দান রুটের কাজ চলমান। এ তিন মেট্রোরেল ছাড়াও যমুনা নদীতে বিদ্যমান বহুমুখী সেতুর সমান্তরালে নির্মাণাধীন স্বতন্ত্র রেল সেতুর অর্থায়নও করছে জাইকা। এ চার মেগা প্রকল্পেই উচ্চ নির্মাণ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। উচ্চ ব্যয়ের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে এসব প্রকল্পে দরপত্র প্রক্রিয়া যথাযথ প্রতিযোগিতামূলক না হওয়াকেও দায়ী করছেন তারা।

জাইকা ছাড়াও বাংলাদেশের আরেক বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি বাংলাদেশের একাধিক মহাসড়ক ও রেল প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক, কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ (এআইআইবি) বিভিন্ন সংস্থার নানা প্রকল্পে অর্থায়ন রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতও বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। ভারতের লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এখনো বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান।

বাংলাদেশে বাস্তবায়িত ও চলমান প্রকল্পগুলোয় দরপত্র প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের চাপ তৈরি করে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি, বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব দেশ ঋণ দেয়, কেনাকাটার ক্ষেত্রে তারা একটা নিয়ম বেঁধে দেয়। যেমন এলওসির (ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট) প্রকল্পগুলোয় ৬৫ শতাংশ নির্মাণসামগ্রী ভারত থেকে নেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। অনেক সময় কেনাকাটায় আমরা বিভিন্ন ধরনের নিয়মের বিচ্যুতি দেখেছি। দুর্নীতির খবরও আমরা দেখি। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণ ব্যয় যেমন বেশি হয়, তেমনি কাজের মানেও ছাড় দেয়ার অভিযোগ ওঠে।’ 

তিনি বলেন, ‘‌বাংলাদেশে দরপত্র প্রক্রিয়াটি অনেকটাই অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। অনেক নিয়মকানুন সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় এগুলোর ব্যত্যয়ও আমরা দেখি। দরপত্র প্রক্রিয়ায়ও আমরা দেখি, সেটি যেভাবে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কথা, সে রকম হয় না। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানই দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। এসব বিষয় থেকে বের হতে না পারলে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও আমাদের ভুগতে হবে।’

দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়ন হচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ঠিকাদার নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না থাকার বিষয়ে এ দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

আরও