নড়াইলে মৌ চাষ

চিনির দামের ঊর্ধ্বমুখিতায় কমতে পারে মধু উৎপাদন

দেশে বাণিজ্যিকভাবে যে কয়টি জেলায় মৌ চাষ হয়, তার মধ্যে নড়াইল অন্যতম। প্রতি মৌসুমে খামারিরা সাত মাস মধু সংগ্রহ করলেও বাকি পাঁচ মাস মৌমাছি লালন-পালন করতে হয়।

দেশে বাণিজ্যিকভাবে যে কয়টি জেলায় মৌ চাষ হয়, তার মধ্যে নড়াইল অন্যতম। প্রতি মৌসুমে খামারিরা সাত মাস মধু সংগ্রহ করলেও বাকি পাঁচ মাস মৌমাছি লালন-পালন করতে হয়। সময় মৌমাছির খাবার হিসেবে নিয়মিত চিনির পানি খাওয়াতে হয়। তবে চিনির দামের ঊর্ধ্বমুখিতায় খাবারের খরচ জোগাতে না পেরে অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতি মৌসুমে নড়াইলে অন্তত ৭০০ টন মধু উৎপাদন হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মৌ চাষীরা বলছেন, নড়াইলে দুই শতাধিক মৌ চাষী রয়েছেন। শীত মৌসুমে যখন মাঠ সরিষা ফুলে ভরে যায়, তখন তারা মৌ বক্স বসান। এভাবে বছরের প্রায় সাত মাস বিভিন্ন ফসলের খেত থেকে মধু সংগ্রহ করেন তারা।

সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের মৌ চাষী মো. বাচ্চু মোল্লা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে মৌ চাষ করেন। তিনি জানান, বছরের সাত মাস মধু সংগ্রহ করেন তিনি। অফ সিজনে মধু উৎপাদন না হওয়ায় বাকি পাঁচ মাস নিয়মিত চিনির পানি খাইয়ে মৌমাছি বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সময় মৌ বাক্স থেকে কোনো মধু উৎপাদন হয় না। মৌমাছির পেছনে শুধু খরচ করতে হয়। খাবার ঠিকমতো না দিলে মৌমাছি মারা যায়। বাজারে চিনির দাম বেশি থাকায় বিপাকে পড়েছেন মৌ চাষীরা। খাবারের অভাবে বাক্সের মৌমাছি বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

নড়াইল ফুল-ফল মৌ চাষী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আবু মুসা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুধু মো. বাচ্চু মোল্লা নয়, জনপদের দুই শতাধিক মৌ চাষীর একই অবস্থা। নড়াইল জেলা তিন যুগ ধরে মধু উৎপাদনে আশপাশের অন্যান্য জেলার মধ্যে এগিয়ে থাকলেও নতুন করে পেশায় কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে নড়াইলের খামারিরা বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন মৌ চাষ। তখন অল্প খরচে লাভজনক হওয়ায় মৌ চাষে আগ্রহ দেখান জনপদের কৃষক। অল্প বিনিয়োগে ভালো লাভ, বর্ষাকালীন খামার পরিচর্যার জন্য উপযুক্ত পরিবেশসহ চাষের অনুকূল অবস্থার কারণে নড়াইলে মৌ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে খামারির সংখ্যা দুই শতাধিক।

সদর উপজেলার কর্মচন্দপুর গ্রামের লিটন কাজী লোহাগড়া উপজেলার শিঙ্গা গ্রামের মওলানা বোরহান উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন মৌ চাষী জানান, বিগত বছরগুলোয় মৌ চাষী বাড়লেও মধুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, চিনির দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে নতুন করে কেউ আগ্রহী হচ্ছেন না। পুরনো যেসব খামারি রয়েছেন, তারাও হিমশিম খাচ্ছেন খামার টিকিয়ে রাখতে। চিনির দাম কমানো, সহজ শর্তে মৌ চাষীদের ঋণ বিতরণসহ সরকারের কাছে বিভিন্ন সহযোগিতা চেয়ে বেশ কয়েকবার মানববন্ধনও করেছেন তারা।

চিনি ব্যবসায়ীরা জানান, তিন বছর আগে ৫০ কেজির এক বস্তা চিনির দাম ছিল হাজার ৬০০ টাকা। বর্তমানে সেই চিনির দাম বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। বাজারে প্রতি বস্তা চিনি বিক্রি হচ্ছে হাজার ৫০ টাকা।

চিনির দাম বাড়ার কারণে মৌ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন অর্ধশতাধিক খামারি। তাদের মধ্যে রঘুনাথপুর গ্রামের হোসেন মোল্লাও একজন। এক যুগেরও বেশি সময় তিনি মৌ চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন প্রতি মৌসুমে অন্তত ২০০ মণ মধু উৎপাদন করতেন। চিনির দাম বাড়ার কারণে দুই বছর আগে তিনি পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। একই গ্রামের আকরাম সিকদার ইমরান সিকদারও একসময় মৌ চাষ করতেন। বাজারে চিনির দাম যে পরিমাণে বেড়েছে, সে তুলনায় মধুর দাম বাড়েনি। ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তারাও পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

সদর উপজেলার রঘানাথপুর গ্রামের মৌ চাষী কওসার হোসেন বলেন, ‘সরকার কৃষকদের সার, কীটনাশক, বীজসহ বিভিন্ন প্রকার কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে ভর্তুকি মূল্যে দিলেও মৌ চাষীদের দিকে নজর দিচ্ছে না।

নড়াইল ফুল-ফল মৌ চাষী সমিতির সভাপতি মো. বাবুল শেখ বলেন, ‘বাক্স পদ্ধতিতে মৌ চাষে প্রতি মৌসুমে একটি বাক্স থেকে দুই-আড়াই মণ মধু উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছর জনপদ থেকে উৎপাদন হয় অন্তত ৭০০ টন মধু। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।

প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশন নড়াইলের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সুলাইমান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নড়াইলে খামারিরা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মধু উৎপাদন করেন। জেলা থেকে বছরে ৭০০ টন মধু উৎপাদন হয়। বিসিক সবসময় মৌ চাষীদের পাশে থেকে সহযোগিতা করে। তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণসহ ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার বিষয়টিও চলমান।


আরও