দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চে ওঠে গত অক্টোবরে, ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সময়ে সময়ে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে কোনো না কোনো খাদ্যপণ্যের বাজার। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে ছিল আলু, পেঁয়াজ, চিনি, কাঁচামরিচ, আটা ও ডিম। এর মধ্যে এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আটার, জুলাইয়ে কাঁচামরিচ, অক্টোবরে বেড়েছে পেঁয়াজ-আলুর দাম।
বেশির ভাগ সময় সিন্ডিকেটের দিকে আঙুল তোলা হলেও কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক সময়ে কৃষিপণ্য আমদানি না করা, উৎপাদনের তথ্য ঠিক না থাকা এবং যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে বিভিন্ন সময় খাদ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
প্রতি বছরই নির্দিষ্ট কিছু সময়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে দেখা যায়। বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগেও ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে অতিমুনাফা করে থাকেন। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষিপণ্যের দাম বাড়লেও কৃষক কিন্তু দাম পাচ্ছেন না। উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রে তথ্য বিভ্রান্তি থাকতে পারে। এগুলো নিয়ে সবসময়ই বলা হয়। আলু ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মনে হয় আমদানি করলাম। ১৫-২০ লাখ টন বেশি উৎপাদন হলে আমদানি কেন করতে হয়? এরপর বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেও বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আলুর ক্ষেত্রে যখন দাম বাড়ে তখন কিন্তু হিমাগারে অনেক মজুদ ছিল। এখানে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা মিলে বাজার অস্থিতিশীল করেছে। অর্থাৎ সিন্ডিকেশনের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে। আবার সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণেও বাজার অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিচ্ছে। বাস্তবায়ন না করতে পারলে সিদ্ধান্ত কেন নেবে? আবার ডলার সংকটের কারণেও এখন আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কে রবি মৌসুম বলা হয়। এ সময় বোরো ধান, গম, সরিষা, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল ও শীতকালীন সবজির চাষাবাদ হয়। ফসল ওঠে মার্চ-এপ্রিলের দিকে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) ফুড সিকিউরিটি মনিটরিংয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল হয়েছিল আটার দাম। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে খাদ্যপণ্যটির দাম ছিল ৫৭ শতাংশ বেশি। আলুর দামও আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। এছাড়া চিনি ৪৮ শতাংশ, ডিম ২৭, সয়াবিন তেল ২০ এবং মোটা চাল ১৪ শতাংশ বেড়ে যায় বছরের চতুর্থ এ মাসটিতে। আটা, চিনি ও সয়াবিন আমদানিনির্ভর হলেও আলু তখন সবেমাত্র ঘরে তুলেছিলেন কৃষক।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি মৌসুমকে বলা হয় খরিপ-১ মৌসুম। এ সময় ভুট্টা, কাঁচামরিচ, আউশ ধান, বিভিন্ন ধরনের মসলা ও গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন করা হয়। তবে জুলাই বর্ষাকাল। সাধারণত তখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ বছর জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল কাঁচামরিচ, চিনি, রসুন, আলু, আটা, ডিম ও মসুর ডালের। এর মধ্যে আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের একই মাসে কাঁচামরিচের দাম বেড়েছিল ১১৬ শতাংশ। এছাড়া চিনি ৬৬ শতাংশ, রসুন ও আলু ৪৩, আটা ২৩, ডিম ১৭ এবং মসুর ডাল ৫ শতাংশ বেড়েছিল।
খরিপ-২ মৌসুম ধরা হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ সময়ে আমন ও আগাম শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাওয়া খাদ্যপণ্যের মধ্যে ছিল পেঁয়াজ, আলু, রসুন, জিরা, চিনিসহ বিভিন্ন শাকসবজি। গত মাসের শেষ দিকে প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজের দাম ছিল ১২৫-১৩০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম চড়েছিল ১১০-১২০ টাকায়। যদিও গত বছরের একই সময়ে প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৫০-৬০ ও আমদানি পেঁয়াজ ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হয়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশী ১৩১ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১১৯ শতাংশ বেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গত অক্টোবরে প্রতি কেজি আলুর দাম ৬৫-৭০ টাকায় ওঠে। যদিও আগের বছরের একই সময়ে পণ্যটির দাম ছিল ২৫-৩০ টাকা কেজি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে যায় আলুর দাম। চলতি বছরের অক্টোবরে রসুন বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৮০-২২০ টাকা। গত বছরের একই সময়ে যার দাম ছিল ৮০-১০০ টাকা। সে হিসেবে রসুনের দাম বেড়েছে ১১৪ শতাংশ। এছাড়া অক্টোবরে এক বছরের ব্যবধানে জিরা ১১৪ ও চিনি ২০ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে অক্টোবরে সবজির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। প্রায় প্রতি কেজি সবজিই ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়। যদিও এ সময়ে বাজারে নতুন সবজি আসার কথা ছিল।
বেশির ভাগ সময় বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের মিল না থাকায় আমদানির ক্ষেত্রে যথাযথ নীতি-নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। তাই কোনো পণ্যের আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অবহিত করা হয়। কিন্তু অনুমতি দিতে দেরি করায় বিভিন্ন সময় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে দেখা গেছে। চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। জুনের শুরুতে পেঁয়াজের কেজি প্রায় শতক ছুঁয়ে ফেলে। এরপর ৫ জুন নিত্যপণ্যটি আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে এর দাম খুব বেশি কমতে দেখা যায়নি।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজার অস্থিতিশীলতার জন্য যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কিছু কারণ রয়েছে। আলুর ক্ষেত্রে তথ্য বলছে, উৎপাদন বেশি হয়েছে। তাহলে বাজারে সংকট তৈরি হলো কীভাবে? আমরা আমাদের মনিটরিং অব্যাহত রেখেছি। ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দেয়ার কারণে বাজারে দাম কমে এসেছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে অনেক আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানির অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেড় মাস দেরি হওয়ায় দাম তখন অনেক বেড়ে যায়। কারণ উদ্বৃত্ত থাকা পেঁয়াজের একটি অংশ সে সময়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল।’
অতিমুনাফা করার কারণে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে বলে মনে করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য হয় না। যেদিন মরিচের দাম বেড়ে যায় বা মরিচের আমদানির অনুমতি দেয়া হয় তখন আমরা মাঠে গিয়ে দেখি কৃষক ১০০-১২০ টাকা বিক্রি করছে। কিন্তু বাজারে এর পরদিন ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। মাঝখানে দামটা বেড়ে যাচ্ছে। আলুর ক্ষেত্রেও কৃষক মৌসুমে ১০-১২ টাকায় বিক্রি করেছে। কিন্তু পরে দাম অনেক বেড়ে যায়। অথচ কৃষক কিন্তু দাম পাননি। হিমাগারের খরচও বেশি না। এখন দেশী পেঁয়াজ ও আলু বাজারে অনেক। উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রে হয়তো একটু কম-বেশি হতে পারে। বাজারে ঘাটতি আছে বা সরবরাহ কম, বিষয়টি এমন নয়। অর্থনৈতিক সূত্র এখানে কাজ করছে না।’
বাজারে দাম বাড়ার পেছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক কিছুই এখন চাষাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু ফসল উঠবে আরো পরে। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যপণ্যের মজুদ কম থাকে। আবার আমদানি পণ্যের দাম নির্ভর করে যেখান থেকে আমদানি করা হয় সেখানে খরচ কেমন তার ওপর। যেমন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ভারতে দাম বেশি। আবার কিছু শর্তারোপও তারা করেছে। ফলে আমদানি খরচ এখন বেশি পড়ছে।’ খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সঠিক সময়ে আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বাণিজ্য সচিব।